ইতাদরি ইউজি
অধ্যায় ১: ধুলিপুরÑসোনালি সাঁঝের গ্রাম
ধুলিপুর ছিল এক নিঃশব্দ কল্পনার গ্রামÑনদীর কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশঝাড়, ধানের খেতে বাতাসের হেলানো ঢেউ, আর ভোরবেলা কাক-ডাকা মধুর নীরবতা। এ গ্রামের মানুষ জানতো কীভাবে পাট কাটতে হয়, মাটি উল্টাতে হয়, কীভাবে মেঘ দেখে বৃষ্টির অনুমান করতে হয়। কিন্তু তারা জানত না কীভাবে গুলি চললে শুয়ে পড়তে হয়, কীভাবে বেঁচে থাকা যায় সব হারিয়ে।
আবু হানিফ ছিলেন এই গ্রামেরই একজন কৃষক। তাঁর বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ, চেহারায় সহজ, শান্ত ভাব। মুখে শাদা গোঁফ, চোখে মাটির ওপর বিশ্বাসের নির্ভরতা। স্ত্রী হাসনাÑএকজন অন্তর্মুখী নারী, যিনি খুব কম কথা বলেন, কিন্তু যার চোখের গভীরতা দেখে হানিফ প্রায়ই থমকে যেতেন।
তাঁদের একমাত্র সন্তান, দশ বছরের মারুফ, ছিল তাঁদের জীবনের আলো। ছেলেটা ছিল একটু গম্ভীর, কিন্তু প্রশ্ন করার অভ্যাস ছিল প্রবল। একদিন সে জিজ্ঞাসা করেছিল, “আব্বু, আকাশে ঘুড়ি ওড়ে কেন?”হানিফ মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন, “ওরা পালাতে চায় আমাদের মতো।”
এই ছোট্ট পরিবারটি বড় চাওয়া পোষণ করতো নাÑএকটা ভালো ঘুড়ি, ভালো ফসল, আর সন্ধ্যাবেলায় হাসনার হাতে পেঁয়াজ ভাজি হলেই পৃথিবীটা তাদের কাছে হয়ে উঠতো পূর্ণ।
অধ্যায় ২: আকাশে যুদ্ধের গন্ধ
তবে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একদিন বিকেলে, যখন ধানকাটা প্রায় শেষ, গ্রামের মুরব্বিদের একজন, হাজী সামাদ, বলে উঠলেন, “টিভিতে দেখলাম, রাজধানীতে আবার গুলি শুরু হইছে।”
প্রথমদিকে গ্রামবাসীরা খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তারা ভাবছিল, “ওসব শহরের ব্যাপার।” কিন্তু একদিন রাতে আকাশে হঠাৎ একটি লম্বা আলোর রেখা দেখা যায়, সঙ্গে আসে বিকট শব্দ। সেদিন প্রথম মারুফ ভয় পেয়ে মায়ের আঁচল ধরে বলেছিল, “আমাদের বাড়িতে কি বোমা পড়বে?’’
এরপর, ঘটনা গড়াতে থাকে দ্রুত। একদিন দুপুরে সেনাবাহিনীর কয়েকটি ট্রাক ঢ়ুকে পড়ে ধুলিপুরে। তারা ঘোষণা দেয়Ñ“এই গ্রামে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি আছে। আমরা খোঁজ নেব।”
প্রথমে তল্লাশি, এরপর জিজ্ঞাসাবাদ। কৃষক আব্দুল কাদেরের ছেলে লিয়াকতকে ধরে নিয়ে গেলÑতার ঘরে নাকি ‘বিদ্রোহী চিঠি’ পাওয়া গেছে। আসলে সেটা ছিল পঞ্চম শ্রেণির বর্ণনা রচনার খাতা।
ধুলিপুর ধীরে ধীরে নিঃশব্দ হতে থাকে। কেউ আর সন্ধ্যার পর বাইরে বের হয় না। মসজিদের আজানও যেন কাঁপা গলায় ওঠে।
অধ্যায় ৩: মৃত্যু আসে নিঃশব্দে
তৃতীয় রাতে, হানিফের পরিবার রাতের খাবার শেষ করেছে মাত্র। মারুফ একটি লাল ঘুড়ির কঙ্কাল নিয়ে বসে ছিলÑতার স্বপ্ন ছিল এটিকে ‘লড়াইঘুড়ি’ বানাবে।
ঠিক তখনইÑএকটি বিকট বিস্ফোরণ। পাশের ঘর কেঁপে ওঠে। হানিফ ছিটকে পড়েন মেঝেতে। চোখে ধোঁয়া, কানে শুধু ‘উঁউঁ’ শব্দ। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
হঠাৎ দেখতে পানÑঘরের দেয়ালের একাংশ ধসে পড়েছে। আর তার নিচে, অচেতন বা মৃত এক শরীর।
মারুফ।
হাসনা কিছু বলছে না। কাঁদছেও না। চুপচাপ সেই শরীরটিকে কোলে তুলে বসে আছে। তার মুখে ভয় নেইÑবরং এক অচেনা, ঠান্ডা শূন্যতা।
অধ্যায় ৪: শরণার্থী শিবির Ñ মৃতের মধ্যে বেঁচে থাকা
তিন রাতের নিঃশব্দ যাত্রা শেষে, হানিফ ও হাসনা এসে পৌঁছায় একটি শরণার্থী শিবিরে। পলিথিনে ঢাকা তাবু, নোনাজল আর কাঁদামাটি, দীর্ঘ সারিতে পানি আর খাবারের জন্য অপেক্ষা। সেখানে মানুষজন শুধু বাঁচে, জীবন বলে কিছু আর থাকে না।
প্রথমদিকে হাসনা কিছুই খেত না। হাত ধোয়া ভুলে যায়, কথা বলা ভুলে যায়, এমনকি রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে দোয়াও পড়ে না। একদিন এক স্বেচ্ছাসেবক মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনার কোনো আত্মীয় আছে এই শিবিরে?”সে বলেছিল, “ছিল। এখন কেউ নেই।”
হানিফ কাঁদত না, তার চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিদিন, সূর্য ডোবার পর, সে বসে বসে মাটিতে একটি গর্ত খুঁড়তÑঅযথা। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলত, “মারুফের ঘর বানাই।”
তিন মাসে শিবিরে অসুখ ছড়িয়ে পড়ে। শিশুরা মারা যেতে থাকে, বুড়োরা নিঃশব্দে হারিয়ে যায়। এমন পরিবেশে হাসনা একদিন কেঁদে ফেলেছিলÑনিঃশব্দে নয়, বুক ফাটিয়ে, মাতৃপ্রলাপ করে।
“ও ঘুড়ি নিয়া কোথায় গেলি রে, ও মা…?’’
অধ্যায় ৫: যুদ্ধ শেষ, কিন্তু শান্তি আসে না
যুদ্ধ শেষ হয় এক ঘোষণায়। শহরের বড় স্ক্রিনে এক নেতার কথা শোনা যায়: “শান্তি ফিরে এসেছে। সবাই ঘরে ফিরুন।”
কিন্তু যাদের ঘর নেই, তাদের ফেরার ঠিকানা কোথায়?
ধুলিপুরে ফিরতে সাহস হয়নি প্রথমদিকে। ফিরোজ নামের এক প্রতিবেশী এসে জানায়, “চাচা, কিছুই নেই। কিন্তু মাটিটা আছে।”
হানিফ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “আমার ছেলে ওই মাটির নিচে। তাকে ছাড়া ফিরতে ইচ্ছা করে না। তবে তাকেই যদি ফিরে পেতে হয়, তাহলে সেই মাটিতেই ফিরতে হবে।”
অধ্যায় ৬: প্রত্যাবর্তন
ছয় বছর পর, ধুলিপুর ফিরে আসে আবু হানিফ ও হাসনা। আগুনে পোড়া ঘরের ছায়া, পোড়া তালগাছ, আর ধানের জমিতে কেবল আগাছা। কিন্তু নদীটা বেঁচে আছে। বাতাসে এখনও ধুলিপুরের সেই পুরনো গন্ধ।
তারা বসতভিটার পাশে বসে। হাসনা মাটি ছুঁয়ে বলে, “ও এখানে ঘুড়ি ওড়াতো।” হানিফ চোখ বন্ধ করে শুধু বলে, “আমি এখনও দেখিতে পাই ওরে।”
তাদের ফিরে আসার খবরে কিছু মানুষ এগিয়ে আসেÑপুরনো বন্ধু, প্রতিবেশী, হারিয়ে যাওয়া পরিবার। কেউ কেউ এসে কাঁদে, কেউ কেউ চুপচাপ হাত ধরে।
একদিন, একটি ছেলেকে হানিফ ঘুড়ি ওড়াতে শেখায়। ছেলেটা জিজ্ঞেস করে, “চাচা, ঘুড়ি কি আকাশে গেলে মরে যায়?’’
হানিফ বলে, “না রে বাবা, ঘুড়ি মরেনা। শুধু সময় হলে মাটিতে ফিরে আসে।”
শেষ পংক্তি:
যুদ্ধ শুধু মানুষ মারে না, সে সময়কেও মেরে ফেলে। সে কাঁদতে ভুলে যাওয়া মানুষ গড়ে তোলে। কিন্তু সেই ধ্বংসের ভেতরেও কিছু বীজ রয়ে যায়, যারা অপেক্ষা করে বৃষ্টির জন্য, ঠিক যেন ধুলিপুরের পাথুরে জমিতে ফাটল ধরার পরে সেখানে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এক নাম না জানা গাছ।