মোঃ নজরুল ইসলামঃ রহিমার চোখে এখনো ভাসে সেই ছবি—বাবা আর মায়ের হাত ধরে কলেজের প্রথম দিনে যাওয়া, আকাশে তখন শরতের নীলিমা। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগেও তাদের পরিবারে হাসির রেশ ছিল, যদিও দারিদ্র্যের ছায়া কখনো সরে যায়নি। রহিমা, দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড়, স্বপ্ন দেখত ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু জীবন তাকে যে গল্প লিখে দিয়েছে, তা যেন কালো কালির দাগে ভরা।
সেই রাতটা সে ভুলতে পারে না। চাচা হঠাৎ এসে মাকে ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললেন। বাবা তখন নদীর ওপারে দিনমজুরির কাজে। মায়ের কান্না, চাচার গর্জন—সব মিলিয়ে রহিমা দরজার আড়ালে কাঁপতে থাকে। পরদিন বাবা ফিরে মায়ের মুখে শুনলেন সবকিছু, কিন্তু তার ঠোঁটে জমাট বাঁধল নিষ্ঠুর নীরবতা। “ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করব না,” শুধু বললেন তিনি। মায়ের চোখে তখন মৃত্যুর স্তব্ধতা।
মামারা এসে মাকে নিয়ে গেল বাপের বাড়ি। গ্রামের পঞ্চায়েতে বিচার হল: চাচাদের থেকে আলাদা হয়ে বাস করবে রহিমার পরিবার। কিন্তু বাবা যেন পাথরের মূর্তি—অভিমানে আটকে থাকা। তিনি ভাইয়ের সিদ্ধান্ত ভাঙলেন না। মামারা রাগে-ক্ষোভে মায়ের জন্য নতুন ঘর বানালেন, আদালতের ডাক পড়ল। রহিমা আর ছোট ভাইবোনেরা মায়ের কোলে গিয়ে ভিড়ল, কিন্তু চাচাদের হুমকি আসতে লাগল রাতের অন্ধকারে। ভয়ে তারা ফিরে এল বাবার কাছে, যেখানে মায়ের জায়গা এখন শুধু ধুলোয় মোড়া একটি শাড়ি।
রাতের নিস্তব্ধতায় ছোট বোন সায়েমা কাঁদে: “আমার গায়ে মায়ের হাত চাই…” বাবা তখন দাওয়ায় তামাক টানতে টানতে বললেন, “তোমার মা আর ফিরবে না।” রহিমার মুঠোফোনে মায়ের ফটো—সেখানে তিনি যেন দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে ফোনে মায়ের কণ্ঠ শুনে ছোটরা জিজ্ঞাসা করে, “বাবা কেন মাকে ভালোবাসে না?”
শীতের সকালে রহিমা মায়ের সাথে দেখা করতে যায়। মা একটি লাল কাপড়ে মোড়ানো বাক্সে রেখে দিয়েছেন তাদের শৈশবের গয়না। “তোমার বাবাকে বলো… আমি অপেক্ষায় আছি,” মা কাঁদেন। কিন্তু বাবা যেন অন্ধকারের দেওয়াল। প্রেম দিয়ে শুরু হওয়া গল্পের শেষ অধ্যায়ে এখন শুধু টুকরো হৃদয় আর অশ্রুর বন্যা। রহিমার ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা: “ভালোবাসা কি এভাবেই মরে যায়? নাকি আমরা শুধু বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ভুলে যাই আলোর কথা?”
পাঁচটি হৃদয় এখনো ধ্বংসস্তূপে আশার দুর্বল চিন্হ খোঁজে। মায়ের জন্য উচ্চারিত প্রতিটি কান্না যেন আকাশে উড়ে যায় অদৃশ্য পায়রার ডানায়। আর রহিমার কলেজের বইয়ের পাতায় শুকিয়ে থাকে এক ফোঁটা অশ্রু—নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে ছোট গল্প
লেখকঃ কলেজ শিক্ষক ও সাংবাদিক,