সকাল থেকেই মিশরের রাজধানীর আকাশে একধরনের অস্থির উত্তাপ। নদীর ঘাট থেকে প্রাসাদের সোনালি গম্বুজ পর্যন্ত মানুষের ভিড়, কারও হাতে খেজুরপাতার পাখা, কারও চোখে উজ্জ্বল কৌতূহল। আজ নাকি রাজদরবারে এক অদ্ভুত প্রদর্শনী হবে। ফেরাউন নাকি এক রাখালের হাতে হার মানাবে। প্রাসাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু স্তম্ভ, সেগুলোর মাথায় ঝুলছে রঙিন পতাকা। লাল, নীল, সোনালি। চারপাশে দারোয়ানদের দেহে ব্রোঞ্জের বর্ম, কপালে তামার মুকুট, হাতে বর্শা। মাঝখানে এক উঁচু সিংহাসন। সেখানে বসে আছে ফেরাউন। তার শরীর সোনার কাপড়ে মোড়া। তার মাথায় সাপের খোদাই করা মুকুট। তার ঠোঁটে একধরনের ব্যঙ্গমাখা হাসি, যা মানুষের হৃদয়ে ভয়ের রেখা এঁকে দেয়। একটু পর দরবারের ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেন এমন একজন মানুষ যার পায়ে ধুলা মাখা চামড়ার জুতো, গায়ে সাদামাটা পোশাক, হাতে এক রাখালের লাঠি। তার মুখে এমন শান্তি প্রকাশ পেল, যা দেখলে মনে হয় মরুভূমির গরম হাওয়ার ভেতর দিয়ে হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে গেছে। তিনি বনি ইসরাইলের মূসা। খোদাবন্দের প্রেরিত নবী। মুসাকে দেখে ফেরাউনে ধীরে ধীরে বলল, শুনেছি তুমি নাকি কিছু জাদু জানো। মুসার কণ্ঠ নরম হলো। কিন্তু স্পষ্ট। আমি জাদুকর নই। আমি যা করব, তা খোদাবন্দের হুকুমে হবে। তখন প্রাসাদের একপাশ থেকে ঢ়ুকে পড়ল ফেরাউনের প্রিয় জাদুকররা। তাদের চোখে এত আত্মবিশ্বাস ছিল যে যেন তারা প্রদর্শনীর আগেই জিতে গেছে। প্রত্যোকের হাতে বাঁশের লাঠি ও দড়ি ছিল। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কিছু মন্ত্র পড়তে শুরু করল। হাতের ইশারায় দড়িগুলো ছুড়ে দিল মাটিতে। লাঠিগুলো ফেলে দিল চারপাশে। মুহূর্তে সেগুলো কেঁপে উঠল। পাক খেয়ে উঠল। আর দেখতে লাগল যেন জীবন্ত সাপ নাচছে, ফোঁস ফোঁস করছে, দাঁত বের করে জনতার দিকে ছুটছে। ভিড়ের মধ্যে চাপা হাঁসফাঁস, কেউ ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল, কেউ আবার চোখ মেলে ফেলফেল করে তাকিয়ে রইল। জাদুকররা গর্বভরে মাথা উঁচু করল, যেন বিজয় আগেই নিশ্চিত। এবার মূসার পর্ব। মুসা ধীরে ধীরে নিজের লাঠি মাটিতে ফেললেন। মুহূর্তে আকাশের বাতাস ভারী হয়ে গেল, যেন সময়ের স্রোত আটকে গেছে। লাঠিটা মাটিতে পড়া মাত্র এক গর্জন শোনা গেল। গর্জন এত গভীর, গুহার ভেতর থেকে ওঠা বজ্রের মতো। তারপর মুহূর্তে লাঠি রূপ নিল এক বিশাল সাপে। চোখ দুটো কয়লার আগুনের মতো জ্বলছে, দেহের আঁশে মরুভূমির ধুলা ঝলমল করছে, মাথা উঁচু করে যেন আকাশ ছুঁতে চাচ্ছে। তারপর এক ঝটকায় সেই সাপ জাদুকরদের সব দড়ি-লাঠিকে গিলে ফেলল। চারপাশে শুধু শোনা গেল ফোঁসফোঁস শব্দ আর সাপের শরীরের ভেতর দিয়ে ভেলকিগুলো হারিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন।উপস্থিত পুরো জনতা থমকে গেল। কারও মুখে আর একটাও শব্দ নেই। ফেরাউনের মুখে হাসি মুছে গিয়ে কঠোরতা নেমে এলো। জাদুকররা একে অপরের দিকে তাকাল। আর কোনো দ্বিধা না করে মাটিতে সিজদায় পড়ে গেল। তাদের ঠোঁটে উচ্চারণ হলো, আমরা মুসা ও হারুনের রবের প্রতি ঈমান এনেছি। দরবারে সেই শব্দ বাজল গম্ভীর প্রতিধ্বনির মতো। প্রাসাদের দেয়াল, বাতাস, এমনকি পায়ের নিচের মাটি যেন জানল, আজ এখানে রাজশক্তির নয়, খোদাবন্দের শক্তির জয় হলো।