বিদেশ : হংকং থেকে ম্যাকাও ু আজ আধুনিক ফেরিতে যেতে সময় লাগে ঘণ্টাখানেক। অথচ একসময় সেই যাত্রা সম্পন্ন হতো মাত্র ২০ মিনিটে এক উড়ন্ত সিপ্লেনে (নৌবিমান)। তবে ১৯৪৮ সালের ১৬ জুলাই এক ফ্লাইট বদলে দেয় সেই ইতিহাস। মাত্র ২০ মিনিটের যাত্রায় ঘটে যায় ‘বিশ্বের প্রথম প্লেন ছিনতাই’, যার রেশ থেকে যায় আজও।
সিগারেট ফ্লাইট
‘মিস ম্যাকাও’ নামে একটি ক্যাটালিনা সি-প্লেন চালাতো ম্যাকাও এয়ার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি। যাত্রীদের কেউ কেউ এটিকে বলতেন ‘সিগারেট ফ্লাইট’—এই যাত্রাপথে একটি সিগারেট ধরিয়ে শেষ করার আগেই প্লেন গন্তব্যে পৌঁছে যেতো। ওই সময় টিকিট কাটার জন্য অগ্রিম বুকিংয়ের প্রয়োজন ছিল না; বাসের মতো প্লেনে ওঠার সময়ই টিকিট কেটে নেওয়া যেতো।
১৬ জুলাই: অদৃশ্য হয়ে গেলো মিস ম্যাকাও
সেদিন প্লেনে ছিলেন ২৭ জন—দুই পাইলট, একজন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট এবং ২৪ যাত্রী। প্লেনটি হংকংয়ের কাই টাক বিমানবন্দরে পৌঁছায়নি। জলসীমায় উদ্ধার হয় ধ্বংসাবশেষ, আর বেঁচে ফেরেন মাত্র একজন—২৪ বছর বয়সী ধানচাষি ওয়াং ইউ। শুরুতে নিজেকে সাধারণ যাত্রী বলে দাবি করলেও পুলিশের সন্দেহ ও তার পালানোর চেষ্টা অবশেষে সব উল্টে দেয়।
আকাশে ডাকাতি: হাইজ্যাকিংয়ের জন্ম
ওয়াং পরে স্বীকার করেন, তিনি তিন সহচরের সঙ্গে প্লেন ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল প্লেন হাইজ্যাক করে দক্ষিণ চীনের গুয়াংডংয়ে নিয়ে যাওয়া, যাত্রীদের লুট করা এবং মুক্তিপণ আদায় করা। কিন্তু ছিনতাইয়ের সময় পাইলট ডেল ক্রেমার প্রতিরোধ করেন, শুরু হয় ধস্তাধস্তি। গোলাগুলিতে দুই পাইলট নিহত হন, আর ক্রেমারের দেহ পড়ার ফলে ককপিটের জয়স্টিক চেপে গিয়ে প্লেনটি সোজা সমুদ্রে আছড়ে পড়ে।
আকাশপথে নিরাপত্তা ছিল হাস্যকর
ছিনতাইকারীরা বন্দুক লুকিয়ে রেখেছিল পায়ের সঙ্গে সুতো দিয়ে বেঁধে, আর বুলেট ছিল জুতার তলার ফাঁপা অংশে। এ ঘটনা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে, কেউ তখন ‘হাইজ্যাকিং’ শব্দটাও ব্যবহার করেনি—তখন একে বলা হচ্ছিল ‘এয়ার পাইরেসি’।
বিচারের গোলকধাঁধা
ম্যাকাও ছিল পর্তুগিজ উপনিবেশ, প্লেনটি ছিল ব্রিটিশ কোম্পানির। ফলে হংকং আর ম্যাকাও—উভয়ই বিচারের দায় এড়িয়ে যায়। ওয়াং ইউকে পরে চীনে ফেরত পাঠানো হয়, কিন্তু বিচার হয়নি আর কখনো। মাত্র ২৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
নতুন যুগের সূচনা
‘মিস ম্যাকাও’ হাইজ্যাক ছিল ‘আকাশপথে অপরাধের সূচনা বিন্দু’। তখন অনেকেই ভাবতেন এটি একক ঘটনা। কিন্তু ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেখা গেলো প্রতি সাড়ে পাঁচদিনে একটি করে প্লেন ছিনতাই হচ্ছে। কেউ চাইতো মুক্তিপণ, কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়, কেউ আবার যাত্রীদের লুট করতো। এই ভয়াল সময়ই তৈরি হয় আকাশপথে নিরাপত্তার কাঠামো—মেটাল ডিটেক্টর, এঙ্-রে, কড়া নজরদারি। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিঙ্ন নিরাপত্তা স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করেন। ১৯৭০ সালে দ্য হেগে গৃহীত হয় প্লেন হাইজ্যাকবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশন। এর মাধ্যমে হাইজ্যাককে ঘোষণা করা হয় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ হিসেবে। পরে ২০০১ সালের ৯/১১ হামলা ও বিভিন্ন চক্রান্ত সব কিছুর ওপর আরও কঠোর নিরাপত্তা চাপিয়ে দেয়। ম্যাকাও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ছোট প্রদর্শনীতে সংরক্ষিত রয়েছে ‘মিস ম্যাকাও’র সেই ইতিহাস, যা বদলে দিয়েছিল গোটা পৃথিবীর আকাশভ্রমণের নিয়মনীতি! সূত্র: সিএনএন