আন্তর্জাতিক: গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে বিপর্যস্ত মানবিক পরিস্থিতি বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই যুদ্ধের নৃশংসতা, ত্রাণ প্রবেশে বাধা এবং বেসামরিক প্রাণহানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ইউরোপীয় ও আরব দেশগুলো একজোট হয়েছে। এ লক্ষ্যে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে আয়োজিত হয়েছে উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক বৈঠক, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা।
এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় রবিবার, ২৫ মে, স্পেনের উদ্যোগে। ‘মাদ্রিদ গ্রুপ’ নামে পরিচিত এই জোটের পঞ্চম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রায় ২০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল আলবারেস বৈঠকের শুরুতেই বলেন, “এই যুদ্ধের এখন আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, সহিংসতা বন্ধ করে গাজায় অবরুদ্ধ মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত করা।”
তিনি আরও জানান, ইসরায়েলের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদ্যমান সহযোগিতা চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের পর এখন সময় এসেছে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার-যেমন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। স্পেন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা চুক্তির তাৎক্ষণিক স্থগিতাদেশ চায় এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞাও বিবেচনায় রয়েছে।
স্পেনের আহ্বানে আয়োজিত এই বৈঠকে অংশ নেয় ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি ও ইতালিসহ ইউরোপের একাধিক দেশ এবং মিসর, সৌদি আরব, জর্ডান, তুরস্ক ও মরক্কোর মতো আরব দেশ। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাঁ-নোয়েল বারো ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নিয়ে বলেন, “যুদ্ধবিরতি, ত্রাণ প্রবেশ ও হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে সমন্বিত চাপ প্রয়োগ করতে হবে।” তিনি আগামী সপ্তাহে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে বৈঠক করার কথাও জানান।
মাদ্রিদের আলোচনায় অংশ নেয়া প্রতিনিধিরা গাজার মানবিক সংকটকে “অসহনীয়”এবং “অমানবিক”বলে আখ্যা দেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, ইসরায়েল যে পরিমাণ ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে (প্রতিদিন ১০০টি), তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। প্রয়োজন অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০টি ট্রাক প্রতিদিন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের ফলে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫৪ হাজার ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। শুধু মার্চের ১৮ তারিখের পর থেকে নতুন করে ইসরায়েলের অভিযানে প্রাণ গেছে ৩ হাজার ৭৪৭ জনের।
আল জাজিরার বরাত দিয়ে জানানো হয়, মাদ্রিদ বৈঠককে ভবিষ্যতের কূটনৈতিক অগ্রযাত্রার ভিত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। আগামী ১৭ জুন নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘ সম্মেলনে ফ্রান্স ও সৌদি আরব যৌথভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে একটি গঠনমূলক প্রস্তাব পেশ করবে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এরই মধ্যে জানিয়েছেন, তার দেশ জাতিসংঘে এমন সব প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেবে যা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক মানবিক দায়বদ্ধতার জন্য জবাবদিহির আওতায় আনতে সহায়তা করবে।
এদিকে মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেল আত্তি বলেন, “ইসরায়েলি পক্ষের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই এখনো যুদ্ধ বন্ধের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।” জার্মানির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্লোরিয়ান হান বলেন, “এই সহিংসতা থামাতে হলে কূটনৈতিক সমাধানকেই একমাত্র পথ হিসেবে দেখতে হবে।”
গাজায় যুদ্ধ থামাতে বিশ্বজুড়ে জনমত ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। গত বছর স্পেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউরোপীয় মিত্রদের বিরাগভাজন হলেও এবার তারা গাজা ইস্যুতে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ঐক্য গড়ার পথে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মাদ্রিদ বৈঠক সেই চেষ্টারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
https://www.kaabait.com