শুভংকর দাস বাচ্চু,কচুয়া (বাগেরহাট)থেকেঃ বাধালে কোটি টাকার কাঁচা-পাকা সুপারির বাণিজ্যের পেছনে রয়েছে শত শত পারুনি শ্রমিকের জীবনঝুঁকির গল্প। ঝড়-বৃষ্টি, ভোরের কুয়াশা, ভয়-ঝুঁকি আর
তীব্র শারীরিক পরিশ্রম—সবকিছু উপো করে তারা গাছে ওঠেন বুকভরা আশঙ্কা নিয়ে
হাসিমুখে কাজ করলেও অন্তরে লুকিয়ে থাকে না-বলা ব্যথা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় প্রায় ১২ হাজার পরিবারের
সুপারি বাগানে কাজ করেন ৭ শতাধিক পারুনি শ্রমিক। চলতি মৌসুমে ১ হাজার ২৩২
হেক্টর জমিতে সুপারি উৎপাদন হয়েছে।
ভোরের আলো ওঠার আগেই শুরু হয় যুদ্ধ-বাধাল ইউনিয়নের মসনী গ্রামের তরুণ
পারুনি শ্রমিক সুজন শেখ (৩২) জানান, গ্রামের মানুষ ঘুম থেকে ওঠার আগেই
আমরা ব্যাগ-দড়ি নিয়ে বাগানে রওনা দিই। অনেকে মনে করে গাছে ওঠা নাকি খুব
সহজ! তারা বোঝে না—প্রতিদিন মৃত্যুভয় নিয়ে গাছে উঠি আমরা। একবার পা পিছলে
গেলে কিছুই থাকে না। দিনে তিন-চার কুড়ি সুপারি তুললেও শরীর ভেঙে যায়।
কিন্তু কাজ না করলে ঘরে খাবারও থাকে না।কথা বলতে বলতে তিনি আকাশের দিকে
তাকান—যেন অগোচর ব্যথার সাী শুধু সেই আকাশ।
তিনবার গাছ থেকে পড়ে মৃত্যুকে জয় করা মানুষ- রঘুদত্তকাঠী গ্রামের প্রবীণ
শ্রমিক গোবিন্দ দাস (৬৫)বহু দুর্ঘটনার সাী। শরীরের অসংখ্য দাগই বলে দেয়
তার জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ পথচলার গল্প।তিনি বলেন,তিনবার গাছ থেকে পড়ে
বেঁচেছি। একবার গাছের গোড়া উপড়ে পড়েছিলাম, আরেকবার হাত ফসকে এক ডালে ঝুলে
কোনোমতে বাঁচি। ভোরের শিশিরে গাছ খুব পিচ্ছিল থাকে, তখনই বেশি দুর্ঘটনা
হয়। হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু কাজ বন্ধ করলে পরিবার না খেয়ে
মরবে—থামার উপায় কী?
শ্রমিকদের অভিযোগ—সুপারি গাছ খুব সরু, বাতাসে ভয়াবহভাবে দুলে, বৃষ্টিতে
পিচ্ছিল হয়। নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই, দড়িও নিম্নমানের।একবার ভুল হলেই
নিশ্চিত মৃত্যু বলেন এক শ্রমিক। তার ভাষায়,“শরীর আর পারে না, কিন্তু
সংসার বলে—হতেই হবে। তাই ব্যথা লুকিয়েই প্রতিদিন গাছে উঠি। এতে ঝুঁকি
আছে, নিরাপত্তা নেই।
শ্রমিকদের ােভ—একদিন কাজ না করলে ঘরে খাবার থাকে না। আর কাজ করলে জীবন
ঝুঁকিতে থাকে। ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ টাকার মাল বিক্রি করে, আর আমাদের ঘর
অন্ধকারই থাকে। মানুষ দেখে শুধু ফলের মূল্য, দেখে না আমাদের ঝুঁকির
জীবনটা।
কোটি টাকার বাণিজ্যের পেছনে অচেনা মানুষগুলো উপজেলায় মৌসুমজুড়ে কোটি কোটি
টাকার সুপারি লেনদেন হয়। কিন্তু সেই বাণিজ্যের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশে
যারা কাজ করেন, তারা পান অল্প মজুরি ও আজীবনের শারীরিক তি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (কৃষিবিদ) আকাশ বৈরাগী বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার
উপজেলায় সুপারি উৎপাদন বেড়েছে। প্রায় ১২ হাজার পরিবারের সুপারি বাগানে ৭
শতাধিক পারুনি শ্রমিক কাজ করেন। পারুনি শ্রমিকদের তালিকা তৈরির বিষয়ে
কর্তৃপরে সঙ্গে আলোচনা করে উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
এলাকার সচেতন মহল বলেন—পারুনি শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে সরকারি সহায়তা,
প্রশিণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।#