পাইকগাছায় সরদার বাড়ির মেয়ে রত্নগর্ভা ডালিমের ত্যাগ, শাসন আর সাফল্যের অনন্য গল্প
প্রতিনিধি:
/ ২
দেখেছেন:
পাবলিশ:
বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫
শেয়ার করুন
ইমদাদুল হক, পাইকগাছা ( খুলনা ): রত্নগর্ভ শব্দটি ইদানিং হরহামেশা ব্যবহৃত হয়। আসলে মাতৃগর্ভ থেকে রত্ন আসেনা। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর সুযোগ সুবিধা হীন এলাকায় সন্তানকে গড়ে তোলার দায়িত্ব যে মা ভালোভাবে পালন করতে পারেন তিনিই সফল মাতা। আজকে আমরা গল্প করব, ধারাবাহিক সফলতার পেছনে একজন মায়ের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে। জঙ্গলাকীর্ণ লস্কর গ্রাম। থানা সদর থেকে দূরত্ব চার কিলোমিটার। মাঝখানে অত্যন্ত খরস্রোতা একটি নদীর কারণে দূরত্ব অনেক বেশি মনে হতো। গ্রামটিতে বিদ্যুৎ এসেছে দুই হাজার সালের পর। সেই গ্রামে ১৯৬২ সালে বধু হয়ে এসেছিলেন মাজেদা খানম। ডাক নাম ডালিম। তিনি ছিলেন সরল গ্রামের ডাক্তার মফিজ উদ্দিন সরদারের বড় মেয়ে। বান্দিকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর তার দাদি তাকে আর হাইস্কুলে পড়তে দেননি। দাদির প্রবল আপত্তিতে আর পড়াশোনা করা হয়নি। তবে লেখাপড়ার প্রতি প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। সেজন্য বিয়ের পর প্রতিজ্ঞা করেন সকল সন্তানকে কমপক্ষে বিএ পাস করাবেন। সারা জীবনের পরিশ্রমে সেই স্বপ্ন সফল করতে পেরেছেন। ডালিম এখন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেন না। লাঠি ভর করে চলতে হয়। তবে আটটি সন্তানের উচ্চশিক্ষা এবং সামাজিক অবস্থান এখন তার পরম শান্তির জায়গা।
লস্কর গ্রামের এক মেধাবী তরুণ এর নাম ছিল মোঃ মনসুর আলী গাজী। তিনি সবসময় পরীক্ষায় প্রথম হতেন। পাইকগাছা হাই স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন যশোর ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলে। চার বছর পড়াশোনা করার পর ১৯৬০ সালে ন্যাশনাল মেডিকেল প্রাক্টিশনার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পাস করার সাথে সাথেই তিনি সরকারি চাকরি পেয়ে যান। পোস্টিং হলো চাঁদখালী সরকারি চ্যারিটেবল ডিস্পেন্সারিতে। কিন্তু কর্মস্থলে যাবার দিন সকালে গ্রামে একটি ছোট্ট মহামারী শুরু হয়। আক্রান্ত মংবুস খুব অসহায় হয়ে নতুন ডাক্তার সাহেবের বারিওতে আসেন। তার পিতা মো: জাফর আলী গাজী তাকে সরকারি চাকরিতে যোগদান না করে গ্রামের অসহায় মানুষদের সেবা করতে নির্দেশ দেন । পিতার এক নির্দেশে তিনি লস্কর গ্রাম থেকেই চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। সেই থেকে লস্কর এবং সোলাদানা দুটি ইউনিয়নে রাস্তাবিহীন, জলমগ্ন এবং কর্দমাক্ত দুর্গম এলাকায় দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। তার সাথেই ডালিমের বিয়ে হয় ১৯৬২ সালে।
শুরু হয় চমৎকার বোঝাপড়ার সাংসারিক জীবন, আর দুজন মিলে সকল সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন।
কঠোর পরিশ্রম করে এই জঙ্গলাকীর্ণ লস্কর গ্রাম থেকে তারা আটটি সন্তানকে কোথায় কোন অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছেন ভাবতে অবাক লাগে। বড় মেয়ে কহিনুর খানম বিএ পাস করার পর জগন্নাথ কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং মাস্টার্স শেষ করার আগেই নোয়াখালীতে একটি এনজিও তে চাকরি শুরু করেন, বর্তমানে রিটায়ার্ড। বড় ছেলে ডক্টর মোঃ মাহবুবুর রহমান আইন শাস্ত্রে ডক্টরেট করে বিদেশে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। মেজো ছেলে ডক্টর মোঃ মেহেদী মাসুদ ইউক্রেন থেকে কম্পিউটার সায়েন্স ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসে আইটি পেশায় নিয়োজিত, বর্তমানে আইটি পেশায় ঈর্ষণীয় সাফল্য তার। সেজো ছেলে মোঃ মোস্তাক আহমেদ বর্তমানে লস্কর হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। এরপর মেরি খানম ম্যাথমেটিক্সে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে খুলনার একটি বেসরকারি কলেজে সহকারী অধ্যাপক। অ্যাডভোকেট মোঃ মোস্তফা কামাল লন্ডন থেকে এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করার পর বর্তমানে ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে ওকালতি করছেন। ডাক্তার মেহেদী হাসান এমবিবিএস পাস করার পর চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে বেশ সাফল অর্জন করেছেন। সবার ছোট মলি খানম ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর এখন স্বামীর সাথে জাপানে বসবাস করছেন।
বিদ্যুৎ বিহীন লস্কর গ্রামে সন্ধ্যার পর নেমে আসতো গাঢ় অন্ধকার। আটটি সন্তান সকলেই পড়াশোনা করেছেন হারিকেনের আলোয়। পশ্চাদপদ অশিক্ষিত এলাকায় তখন চারিদিকে ছিল কথিত ভুতের ভয়। পড়তে বসে সকলেই থাকতো ভীতসন্ত্রস্ত। সবার ছিল পৃথক একটি হারিকেন আর একটি ছোট্ট চেয়ার টেবিল। তখনকার দিনে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা টিফিন পিরিয়ডে কিছু খেত না। সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে যাওয়া আর বিকেলে ফিরে এসে খাওয়া। একটি নদী পার। দীর্ঘ চার কিলোমিটার হেঁটে আসা। সন্ধ্যায় সবাই থাকতো ক্লান্ত। যে কারণে সন্ধ্যায় পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলে মা-বাবা কখনো রাগ করতেন না। কিন্তু একটি বাধ্যতামূলক নিয়ম ছিল। সেটি হলো রাত তিন টায় ডেকে দেওয়ার সাথে সাথে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসা। হারিকেনের আলো বেশি দূরে যায় না, নিজের শরীরের ছায়াটাও হয় অনেক বড়। অল্প আলোর বাইরে অন্ধকার জগতে ভূতের ভয় বেশি মনে হয়। সন্তানদের ভূতের ভয় দূর করার জন্য স্বামী স্ত্রী পাশে বসেই কোরআন শরীফ পড়তেন ভোরের আলো স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত। এরপর ডালিম যেতেন রান্নাঘরে সন্তানদের খাবার তৈরির জন্য ।
ডালিমের নিয়ম গুলো ছিল খুব কঠোর। সেটি তার নিজের জন্য এবং সন্তানদের জন্য। যেমন, মাগরিবের আজানের সাথে সাথে বাড়ির সিংহ দরজা বন্ধ করে দেওয়া। আজান শেষ হওয়ার পূর্বেই সকল সন্তান খেলাধুলা ফেলে দৌড়ে এসে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই হবে। তারপর অজু করে নামাজ আদায় করে স্কুলের বই পড়তে বসা। সন্ধ্যার আগে তিনি প্রত্যেক সন্তানের হারিকেনগুলো পরিষ্কার করে জ্বালিয়ে রাখতেন। সকালে ঠিক সময় মত সন্তানেরা স্কুলে যাবে সেজন্য খাবার তৈরি করে রাখতেন। আর টিফিন পিরিয়ডে না খেয়ে থাকা সন্তানেরা বিকেলে বাড়িতে ফিরেই যাতে দুপুরের খাবারটা পায় সেজন্য সময়মতো তা তৈরি করে রাখতেন। কখনো কোনদিন এসব নিয়ম ভঙ্গ হয়নি। বড় সংসার অর্থকষ্ট নেই স্বাচ্ছন্দ আছে তারপরেও সারাজীবন কাজের লোকদের সাথে কাজ করে গেছেন সমানভাবে। এর মাঝেও তার ছিল খুব বই পড়ার নেশা। মোহাম্মদ হোসেন এর লেখা আনোয়ারা উপন্যাসটি তিনি বারবার পড়তেন। জীবনে সবচেয়ে বেশিবার পড়েছেন এই উপন্যাসটি। কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু ক্ষুধা, বাঁধন-হারা, কুহেলিকা; রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি, গোরা, ঘরে-বাইরে, শেষের কবিতা; বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, বিষবৃক্ষ, দেবী চৌধুরাণী; বেগম রোকেয়ার গল্প সুলতানার স্বপ্ন, অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ এসব তিনি পড়তেন। শওকত ওসমানের উপন্যাস জননী; শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক; আহমদ ছফার সূর্য তুমি সাথী; শরৎচন্দ্রের দেবদাস, শ্রীকান্ত, দত্তা, গৃহদাহ, বিন্দুর ছেলে তিনি পড়েছেন। নবীজির জীবনী, রাবেয়া বসরি সহ জীবনী গ্রন্থ পড়ার আগ্রহ ছিল বেশ। জীবন সংগ্রাম মনিসিং বইটি পড়ে ইলা মিত্র কিভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন সেটি ভেবে তিনি খুব শকড ছিলেন দীর্ঘদিন। ভুলতে পারতেন না। রেডিওতে সাপ্তাহিক নাটক শোনার নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন তিনি। প্রতি বুধবার এবং শনিবার রাতে খুলনা বেতার এবং ঢাকা বেতার থেকে নাটক প্রচার হতো। রাতে খাবার পর সন্তানদেরকে এই নাটক শুনবার সুযোগ দিতেন। মজিদের মায়ের আসর নামে একটি কমেডি অনুষ্ঠান মাঝেমাঝে শুনতেন। রোববার দুপুরের পর আকাশবাণী এবং বিবিধ ভারত থেকে প্রচারিত নির্দিষ্ট সময়ে প্রচারিত দুই একটি নাটক তিনি নিয়মিত শুনতেন।
কয়েকটি বিষয়ে এই দম্পতির চারিত্রিক বৈশিষ্টে ছিল আশ্চর্য রকম মিল। যেমন, কথা সহ্য করার ক্ষমতা, প্রতিবেশী বা কারো সাথে কোন পর্যায়ে উচ্চস্বরে কথা না বলা এবং অন্যের কথা গোপন রাখার ক্ষমতা, বাড়ির চারপাশের মানুষদেরকে সাহায্য করা। দুজনেই নিরব প্রতিজ্ঞা মনের ভেতরে ধরে রাখতেন অত্যন্ত বিনীতভাবে। দুটি উদাহরণ দেওয়া যায়, বড় ছেলে যখন ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন তখন ডালিমের চাচারা বলেন, ছেলেটির আর লেখাপড়া হবে না। তিনি নীরবে জীদ ধরে তাদের পুরাতন বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করেন কিন্তু কাউকে বলেননি। বড় ছেলে যখন এলএলএম পাস করে ঢাকায় হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন তারপর তিনি আবার যাওয়া শুরু করেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ এই ১০ বছর তিনি যেতেন না কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি। মেয়েদেরকে পড়াশোনা করানোর জন্যও আত্মীয়-স্বজন থেকে অনেকেই তখন সমালোচনা করতেন। গ্রাম্য পরিবেশে তখনকার দিনে এটি ছিল স্বাভাবিক। সে বিষয়গুলো জয় করার জন্য তার ছিল নীরব প্রতিজ্ঞা।
তার স্বামী ডাক্তার মনসুর আলী গাজী ছিলেন একই রকম বিনয়ী এবং সাহসী মানুষ। যেমন ১৯৬০ সালে তিনি চার বছরের ন্যাশনাল মেডিক্যাল কোর্স এবং ইন্টার্নশীপ সম্পন্ন করে ডাক্তার হন। ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার এই কোর্সটি বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে আরো এক বছর পড়ার সুযোগ দিয়ে এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জনের সুযোগ দেন। তিনি দুটি ইউনিয়নের দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে এত বেশি দায়িত্বে আবদ্ধ হন যে এই এমবিবিএস ডিগ্রি নিতে যাওয়ার সময় পাননি। পাকিস্তান সরকার এই কোর্সের শেষ দুটি ব্যাচের ছত্রদের ডাক্তারি করার জন্য রেজিস্ট্রেশন নাম্বার প্রদান করেনি। সেজন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করেন। ১৯৬১ সাল থেকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে হাইকোর্টে ভাষা সৈনিক গাজিউল হক কে উকিল হিসেবে নিয়োগ করেন। ১৯৮০ সালে এই মামলায় তিনি বিজয়ী হন এবং ডাক্তারি করার জন্য রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত হন যারা নম্বর ১২৯৯। আত্মসম্মানবোধ এত বেশি ছিল যে রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্তির পূর্ব দিন পর্যন্ত প্রতিবাদ হিসেবে সাদা কাগজে প্রেসক্রিপশন লিখতেন। এই মামলায় বিজয়ের পর প্রেসক্রিপশন করার জন্য ঢাকা থেকে প্যাড ছাপিয়ে নিয়ে বাড়ি আসেন। তখন থেকে ছাপানো প্যাডে প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করেন। লস্কর এবং সোলাদানা দুটি ইউনিয়নের মানুষ যাতে এক দিনের জন্য চিকিৎসা বিহীন না থাকে সেজন্য যত কষ্টই হোক তিনি মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকায় যাতায়াত করতেন নাইট কোচে। এসব বিষয়ে মানসিক শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন ডালিম। এই চমৎকার বোঝাপড়া আজকের এই সফলতার পেছনে সবচেয়ে বড় বিষয় । সাইকেলে বা নৌকা যোগে এই দুটি ইউনিয়নের রোগীদের বাড়িতে গিয়ে রোগী চিকিৎসা করা ছিল অনেক সময়ের ব্যাপার। ফোনের কোন ব্যবস্থা তখন ছিল না। অনেক রোগী সকালে এসে ডাক্তার না পেয়ে অপেক্ষা করতেন। দুপুর বা বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষারত রোগীদেরকে দুপুরের খাওয়া এবং গোসলের সুযোগ দেবার ক্ষেত্রে কোনদিন বিরক্ত হননি ডালিম। মানুষের কষ্ট তিনি ভাগ করে নিতেন। এই ত্যাগের জন্য কাছের ও দূরের বহু মানুষের কাছে তিনি মহানুভব হয়ে আছেন।