আনন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে ঘটে গেছে এক নজিরবিহীন চুরির ঘটনা। গত রোববার সকালে জাদুঘর খোলার কিছুক্ষণ পরই কয়েকজন মুখোশধারী অনুপ্রবেশকারী অ্যাপোলো গ্যালারিতে ঢ়ুকে নেপোলিয়ন যুগের আটটি মূল্যবান রত্নালংকার চুরি করে নিয়ে গেছে। চোরের দল এত দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ সেরেছে যে কারও কারও কাছে এটিকে হলিউডের কোনও সিনেমার গল্প মনে হয়েছে। গতকাল লুটের এ ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত এক প্রতিবেদন করেছে আল জাজিরা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, লুটেরাদের ধরতে গত রোববার সারাদিনজুড়ে প্যারিসজুড়ে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এখনও ল্যুভর মিউজিয়ামটিকে ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফ্রান্স সরকার ও জাদুঘরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনুপ্রবেশকারীরা আসবাব তোলার একটি মই ব্যবহার করে জানালা ভেঙে গ্যালারিতে প্রবেশ করে। মাত্র চার মিনিটের মধ্যেই তারা জাদুঘরের ভেতর থেকে রত্নালংকারগুলো নিয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। যাওয়ার পথে তারা আরেকটি মূল্যবান অলংকার ফেলে রেখে যায়। চুরির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাঁক্রো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, যে ঐতিহ্যকে নিয়ে আমরা গর্বিত হই, এটি তার ওপর একটি আক্রমণ। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন ম্যাঁক্রো। তিনি বলেছেন, ‘এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্যারিস প্রসিকিউটর দপ্তরের নেতৃত্বে সব জায়গায় সবকিছুই করা হচ্ছে।’
যা যা নিয়ে গেছে লুটেরারা
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে গত রোববার সন্ধ্যায় নিশ্চিত করে বলা হয়, লুটেরারা দুটি উচ্চ-নিরাপত্তাযুক্ত প্রদর্শনী কেস থেকে আটটি বহুমূল্য রত্নালংকার চুরি করে নিয়ে যেতে সফল হয়েছে। চুরি যাওয়া বস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে, ফরাসি সম্রাট প্রথম নেপোলিয়নের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী মেরি-লুইজের ব্যবহার করা কয়েকটি অলংকার, বাকি মূল্যবান বস্তুগুলো নেপোলিয়ন তৃতীয়ের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী উজিনির। চুরি যাওয়া অলংকারগুলো হলো-সম্রাজ্ঞী মেরি-অ্যামেলি এবং সম্রাজ্ঞী হরটেন্সের অলংকার সেটের টিয়ারা এবং নীলমণি বসানো কণ্ঠহার। নীলমণি বসানো একটি অলংকার সেটের একটি কানের দুল, রানি মেরি-লুইজের অলংকার সেটের পান্না বসানো কণ্ঠহার, তাঁর পান্না বসানো এক জোড়া কানের দুল, ‘রিলিকোয়ারি’ নামে পরিচিত একটি মহামূল্যবান ব্রোচ এবং সম্রাজ্ঞী উজিনির টিয়ারা ও বড় একটি ব্রোচ। তবে, জাদুঘরের বাইরের দেয়ালের কাছে পড়ে থাকা অবস্থায় সম্রাজ্ঞী উজিনির মুকুট পাওয়া গেছে। খুব সম্ভবত পালিয়ে যাওয়ার সময় চোরের দল সেটি ফেলে রেখে যায়। সেটিতে ১ হাজার ৩৫৪টি হীরা ও ৫৬টি পান্না রয়েছে। চুরির সময় সেটির ক্ষতি হয়েছে। মূল্যবান শিল্পকর্ম চুরি বিশেষজ্ঞ এবং ‘স্টিলিং রেমব্রান্টস: দ্য আনটোল্ড স্টোরিজ অব নটোরিয়াস আর্ট হিস্টস’ বইয়ের সহলেখক অ্যান্থনি আমোরে আল-জাজিরাকে বলেন, এসব বস্তু শুধু অর্থের দিক দিয়েই মূল্যবান নয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও অমূল্য। অ্যান্থনি আমোরে বলেন, ‘এটি কোনো মাস্টারপিস চুরির মতো নয়, যেখানে সংবাদমাধ্যম সঙ্গে সঙ্গে সেটির ছবিটি প্রকাশ করবে। এ ধরনের বস্তুগুলো হয়তো টুকরা টুকরা করে ভেঙে ফেলা হবে এবং তারপর পৃথক রত্ন হিসেবে বিক্রি করা হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে সেগুলো চেনাও সম্ভব হবে না।’
যেভাবে চুরির মিশন সফল করল চোরেরা
ল্যুভর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ বলেছে, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, মোটরসাইকেল ও দারুণ দক্ষতার মিশেলে চোরের দল দুর্র্ধষ এই চুরিতে সফল হয়েছে। পুলিশের একটি সূত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছে, চোরের দলটি অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার নিয়ে একটি স্কুটারে চড়ে ল্যুভর জাদুঘর প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। চোরেরা ভাঁজ করা যায় এমন একটি মই ব্যবহার করে বাইরের দিকে থেকে গ্যালারিতে ঢোকে এবং ডিস্ক কাটার দিয়ে জানালার কাচ কেটে ভেতরে প্রবেশ করে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় টিএফ১ নিউজকে বলেন, সে সময় তিনি কাছাকাছি সাইকেল চালাচ্ছিলেন। তিনি দেখেছেন দুজন ব্যক্তি মইয়ে বেয়ে ওপরে উঠে জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করছেন। এই পুরো কাজে তাঁরা মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলেন।
ফরাসি আরেকটি পত্রিকার খবরে বলা হয়, চোরের দল একটি পুরোনো প্রাসাদের ভেতরে অবস্থিত ওই জাদুঘরে প্রবেশ করে। প্রাসাদটি সিন নদীর দিকে মুখ করা। সেখানে সংস্কারকাজ চলছিল। ওই পত্রিকায় আরও বলা হয়, দুই চোর নির্মাণশ্রমিকদের মতো হলুদ রঙের ভেস্ট পরে ছিলেন।সংস্কৃতিমন্ত্রী রাশিদা দাতি বলেন, চুরির তথ্য পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে কর্তৃপক্ষ সেখানে উপস্থিত হয়। সত্যি বলতে, মাত্র চার মিনিটের মধ্যে চোরের দল এই কাজ করেছে। সবকিছু হয়েছিল খুবই দ্রুত। চুরির পর ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, জাদুঘর ভবনের সামনের দিকে একটি ভাঁজ করা মই দাঁড়িয়ে আছে। মইটি যেখানে রাখা, সেখান দিয়েই চোরের দল ভবনে প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা হয়। পরে মইটি সরিয়ে নেওয়া হয়। চাঞ্চল্যকর এ লুটের কাণ্ড ঘটানো চোরের দলটি এখনও ধরা পড়েনি। প্রমাণ সংগ্রহ করতে ফরেনসিক দলগুলো ল্যুভর জাদুঘর ও আশপাশের সড়কগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়েছে। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে সেগুলোতে সন্দেহজনক কিছু আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। গত রোববার ঘটনার সময় যেসব কর্মী জাদুঘরে দায়িত্বরত ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে আলাদাভাবে ঘটনার বিবরণ নেওয়ার পরিকল্পনাও করা হয়েছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী রাশিদা দাতি বলেন, চোরেরা পেশাদার ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আজকাল সংঘবদ্ধ অপরাধীরা শিল্পকর্মকে নিশানা বানাচ্ছে এবং জাদুঘরগুলো অবশ্যই তাদের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে।’ শত বছরের বেশি সময় আগে ল্যুভরে সাড়া জাগানো এক চুরির ঘটনা ঘটেছিল। ১৯১১ সালে জাদুঘরটি থেকে ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্ম লোপাট করা হয়। দুই বছর পর ১৯১৩ সালে ইতালির একটি হোটেল থেকে সেটি উদ্ধার হয়। পরে আবার মোনালিসাকে ল্যুভরে ফিরিয়ে আনা হয়। যাই হোক, দিনে-দুপুরে ল্যুভর মিউজিয়ামের মতো একটি জায়গায় এমন দুর্র্ধষ চুরি উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে ফ্রান্সের সব নাগরিক ও রাজনীতিকদের। কেউ কেউ এই বিখ্যাত জাদুঘরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে হতাশাও প্রকাশ করেছেন।