• সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫, ০৫:৫৭

সুন্দরবনে ফের দস্যুতা

প্রতিনিধি: / ৪ দেখেছেন:
পাবলিশ: সোমবার, ৯ জুন, ২০২৫

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বাংলাদেশের সুন্দরবন। দীর্ঘদিন পর এই বনে আবারও দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। ইতিমধ্যে বনজীবীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। নতুন করে দস্যুদের বাহিনী গড়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বনজীবী ও জেলেরা। বনের বিভিন্ন এলাকায় তাদের ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন তারা। এছাড়া এক দস্যু বাহিনীর হাত থেকে অন্য দস্যু বাহিনীর হতে দখল হাতবদলের খবরও রয়েছে। বনজীবী ও জেলেরা বলছেন, দস্যুদের বিভিন্ন বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর দস্যু আতঙ্ক কেটে গিয়েছিল। জেলেরা স্বস্তি নিয়ে মাছ শিকার করেছিলেন। বনের ওপরে নির্ভরশীল মানুষের জীবনেও স্বস্তি এসেছিল। কিন্তু আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দস্যুরা। এতে জেলে ও বনজীবীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা বনজীবী ও বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেরা জানান, খুলনার কয়রা, দাকোপ ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃতি পশ্চিম সুন্দরবনে আসাবুর বাহিনী, শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী নামে বনদস্যুদের নতুন কয়েকটি দল তৎপরতা শুরু করেছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জেল ভেঙে পালিয়ে আসা কয়েদি ও চিহ্নিত আসামিরাও সুন্দরবনে দস্যুতা শুরু করেছে। তারা সুন্দরবনে মৎস্য আহরণে যাওয়া জেলেদের কাছ থেকে মাছ, টাকা, মোবাইলসহ সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। এমনকি বনে ঢুকলে জেলেদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের চাঁদাও দাবি করছে। নৌকায় করে এসব বনদস্যু সুন্দরবনের গহীনে অবস্থান করে। বনের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এদের আস্তানা। সুযোগ বুঝে কখনও মাছ ধরার ট্রলার, জেলে কিংবা বনজীবীদের জিম্মি করে তারা। অপহরণের পর দস্যুরা তাদের আস্তানায় নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরিবারের কাছে চাওয়া হয় মুক্তিপণ। অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে তাদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়েছেন। অন্যদিকে, টাকার বিনিময়ে হাতবদল হয়েছে অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ। এতদিন ছিল মজনুবাহিনীর হাতে থাকলেও এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে এটা চলে গেছে আলিফ ওরফে দয়ালবাবার নিয়ন্ত্রণে। এক্ষেত্রে চুক্তি হয়েছে ৫৮ লাখ টাকার। এ টাকার বিনিময়ে ছয় মাস সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে নতুন বাহিনীর হাতে। নতুন বাহিনীর প্রধান এর আগে মজনুবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কাজ করতেন। চুক্তি অনুযায়ী, মজনু ইতোমধ্যে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন দয়ালবাবার কাছ থেকে। বাকি টাকা পাবেন তিন মাসের মধ্যে। এরই মধ্যে কিছু অস্ত্র এবং গোলাবারুদ হস্তান্তর করে পার্শ্ববর্তী একটি দেশে পাড়ি জমিয়েছেন মজনু। যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব তথ্য। জানা যায়, যেসব জলদস্যু ও বনদস্যু ইতঃপূর্বে সরকারের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাদের অনেকেই আবার ফিরেছেন পুরোনো পেশায়। দয়ালবাবার নেতৃত্বাধীন দস্যুদলে এ মুহূর্তে নয়জন দস্যু আছে। এ নয়জনের মধ্যে চারজন আত্মসমর্পণ করে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়েছিলেন। এ চারজনের মধ্যে দয়ালবাবা ছাড়া খোকাবাবু এবং আব্দুল্লাহর নাম জানা গেছে। আরও জানা যায়, সমপ্রতি শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ, রমজান নগর, কৈখালী ও ঈশ্বরিপুর ইউনিয়নের ১৫ জেলেকে অপহরণ করেছে দয়ালবাবা বাহিনী। মুক্তিপণের বিনিময়ে তারা এরই মধ্যে ফিরে এসেছেন। বনজীবী ও জেলেরা জানিয়েছেন, গত তিন মাসে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ২০ জনের বেশি জেলে ও মৌয়াল অপহরণের শিকার হন। তাদের কাছে দাবি করা হয়েছে ১০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। বেশ কয়েকটি অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন অপহৃতকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। কোস্টগার্ড, বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিল। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। তবে গত তিন মাসে অপহরণের ঘটনাগুলো জানান দিচ্ছে আবারও বনে দস্যু বাহিনীর উত্থান ঘটেছে। সমপ্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা এক জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সুন্দরবনে এখন যে কয়েকটি দস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে, তার মধ্যে দয়াল বাহিনী দুর্ধর্ষ। বাহিনীর সদস্যরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মাছ ধরার ট্রলারে হামলা করে জেলেদের অপহরণ করে তাদের আস্তানায় নিয়ে যায়। পরে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। মুক্তিপণের টাকা না দিলে নির্মম নির্যাতন চালায়। কাউকে কাউকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না তারা। স্থানীয়দের মতে, বনজীবীরা খুব বিপদে আছেন। বিভিন্ন বাহিনীর কাছে তারা জিম্মি দীর্ঘদিন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হয়েছিল সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে মোটেই দস্যুমুক্ত হয়নি। যেসব দস্যু আত্মসমর্পণ করেছে বলা হয়েছিল, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আগে যেমন অপকর্ম করেছে, এখনো করছে। এখন ডাকাতদের তৎপরতা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। ১২ মাসের মধ্যে পাঁচ মাস সরকারিভাবে সুন্দরবনে কর্মতৎপরতা বন্ধ থাকে। বাকি সাত মাসে যে টাকা রোজগার করে, তাতে মহাজন, বিভিন্ন বাহিনী ও দস্যুদের দেওয়ার পর পেট চলা কঠিন। এ অবস্থার পরিত্রাণ জরুরি। এদিকে, এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সুন্দরবনের জলসীমা অধিকতর সুরক্ষার জন্য সমপ্রতি বয়াসিং এলাকায় ভাসমান বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি) উদ্বোধন করা হয়েছে। বিজিবির এই বিওপি ছাড়াও সুন্দরবন এবং জেলেদের রক্ষায় র‌্যাব, পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন বিভাগের লোকদের আরও তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, এতে অপরাধীদের তৎপরতা বন্ধ হবে।


এই বিভাগের আরো খবর
https://www.kaabait.com