ইমদাদুল হক,পাইকগাছা(খুলনা) : আইনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও পাইকগাছার খাল-বিল, ধানক্ষেত ও জলাশয়জুড়ে রীতিমতো পাখি হত্যার মহোৎসব চলছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে শিকারিরা প্রতিদিন নতুন কৌশলে দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির পাখি শিকার করছে। শীত মৌসুমে পাখি হত্যার উন্মাদনা থামেনি বরং আরও বেড়েছে শিকারিদের তৎপরতা।
উপজেলার বিভিন্ন বিলে খুঁটি পুঁতে বিশাল কারেন্ট জাল টাঙিয়ে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ ফাঁদ। কয়েক একরজুড়ে বিস্তৃত এসব জালে সকাল হলে ঝুলতে দেখা যায় বালিহাঁস, সাদা বক, পানকৌড়ি, সরালী, শামুকখোলসহ নানা পাখির নিথর দেহ। উপজেলার বয়রা, কচুবুনিয়া, বাইসারাবাদ, তেঁতুলতলা, লতা, হানিমুনকিয়া, দেলুটি, সোলাদানা, খড়িয়া, চকবগুড়া, আমিরপুর, বাইনবাড়ীয়া, কুমখালী এবং পৌরসভার বিভিন্ন বিলে একই দৃশ্য।
এলাকাবাসীর ভাষ্য—“কখনো ফসলের ক্ষেতে, কখনো ঘেরের পাশে, আবার কখনো খালের ধারে জাল দেখে আমরা ভয়ে যাই। রাতে পাতা জালে সকালে মৃত পাখি পড়ে থাকে স্তূপ করে।”
প্রচলিত ফাঁদের পাশাপাশি এবার যোগ হয়েছে আরও ভয়াবহ একটি পদ্ধতি। শিকারিরা ইন্টারনেট থেকে পাখির ডাক রেকর্ড করে সাউন্ড বক্সে বাজিয়ে ধানক্ষেত, বিল ও ঘেরের পাশে ফাঁদ পেতে বসে থাকে।
এই নকল ডাক শুনে আশপাশের পরিযায়ী পাখি মনে করে তাদের দল ডাকছে—আর দলবেঁধে এসে ধরা পড়ে ফাঁদে।একজন স্থানীয় কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,“এটা হত্যার চেয়েও ভয়ংকর। পাখির ডাক নকল করে ওদের প্রতারণা করা হচ্ছে। ওরা নিরাপদ মনে করে আসে, আর মৃত্যুর মুখে পড়ে।”
শুধু জাল নয়—অনেক শিকারি মাছ, ব্যাঙ, ফড়িং জাতীয় খাদ্যে বিষ মিশিয়ে ফাঁদ পেতে রাখে। খাদ্যের সন্ধানে আসা পাখিরা এসব বিষ খেয়ে অল্পক্ষণেই মাটিতে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে করতে মারা যায়।প্রতিদিনই এভাবে শত শত পাখি নিধন হচ্ছে—কেউ দেখছে, কেউ দেখেও না দেখার ভান করছে।
স্থানীয় বাজার, চায়ের দোকান ও ঘাটে মাঝেমধ্যেই দেখা যায় ৩০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় পাখি বিক্রি হচ্ছে। কেউ রসনার তৃপ্তির জন্য, কেউ শখে কিনে নিয়ে যায়।
মনে রাখা জরুরি—এ পাখিগুলো শুধু খাদ্য নয়, পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশে প্রায় ৭৪০ প্রজাতির পাখি রয়েছে, আর বিশ্বে আছে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতি। এদের অনেকেই প্রতিবছর শীত এলেই পাইকগাছার মতো উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয় নেয়।
কিন্তু নির্বিচারে শিকার, বিষটোপ, শব্দদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাখিদের অস্তিত্ব চরম হুমকির মুখে।
পরিবেশবিদদের মতে— “যে সমাজ তার পাখিদের রক্ষা করতে পারে না, সে সমাজ নিজের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে পারবে না।”বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী
পাখি শিকার, হত্যা, বিক্রি, পরিবহন—সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কিন্তু পাইকগাছায় আইন প্রয়োগ খুবই দুর্বল। দুই-একটি অভিযান হলেও শিকারিরা আবার ফিরে আসে আগের চক্রে।
নির্মল কুমার পাল, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (খুলনা) জানান, “আমাদের নজরদারি অব্যাহত আছে। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আমরা দ্রুত অভিযান পরিচালনা করতে পারব।”
এলাকাবাসীর দাবি—
“চাই নিয়মিত অভিযান, রাতের টহল, জাল জব্দ, জরিমানা। না হলে আগামীতে পাখি আর দেখা যাবে না।”পাখি বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে—প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে
পাইকগাছার বিল, মাঠ, জলাশয়—কত গল্প লুকিয়ে রেখেছে এই পাখিরা। তারা শুধু আকাশের সৌন্দর্য নয়; তারা প্রকৃতির বার্তা।আজ যদি আমরা তাদের বাঁচাতে না পারি, কাল আমাদের সন্তানরা আর পাখির ডাক শুনে বড় হতে পারবে না।পাখিদের ডানা যেন না ছিঁড়ে যায় আমাদের অমানবিকতায়—এখনই সময় শিকার বন্ধে একসঙ্গে দাঁড়ানোর।