নগর জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য নেওয়া ১১৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প ভুল পরিকল্পনা, বাজেট অসঙ্গতি এবং কোডিং ত্রুটিতে দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। অনুমোদনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও অগ্রগতি প্রায় নেই বললেই চলে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এতবার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার পরও সংশোধন না হওয়া প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তোলে।
প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রস্তাবনা তৈরি থেকে অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই একের পর এক ত্রুটি ধরা পড়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রকল্পটি নেয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, সাভার ও তারাবো পৌরসভার জন্য। ২৯ নভেম্বর ২০২৩ একনেক অনুমোদনের পর দ্রুত কাজ শুরুর কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি।
অর্থনৈতিক কোডিং ত্রুটি ছিল প্রথম বড় বাধা। ২৩৮টি কোডের মধ্যে ৯৪টিতে ভুল শনাক্ত হয়, যার কারণে ৬৯টি দরপত্র প্রক্রিয়া আটকে আছে। এমনকি ঢাকা মশা নিয়ন্ত্রণ অফিস ভবনের বর্ধিত অংশের আয়তনও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় ভুল দেওয়া ছিল। যেখানে প্রস্তাবে দুই তলার জন্য দেখানো হয়েছে ৪৯৮৭ বর্গফুট, বাস্তবে সেই জায়গা ১২৪০০ বর্গফুট।
বাজেট বরাদ্দ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মুদ্রণ ও প্রকাশনার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা, অথচ লালবাগের ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের দুই তলা বাড়াতে বরাদ্দ মাত্র ৬ কোটি টাকা। প্রকৌশলীরা এটিকে অযৌক্তিক বলছেন। একইভাবে ৬০ কর্মকর্তার প্রশিক্ষণে ৯৫ কোটি টাকা এবং বিদেশ প্রশিক্ষণে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।
প্রকল্পের অগ্রগতি বলতে আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ২ কোটি টাকা, যা ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ পাওয়া ১২ বিশেষজ্ঞের বেতন হিসেবে খরচ হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ নিয়োগও প্রশ্নের মুখে। নিয়োগ পাওয়া ১২ জনের মধ্যে তিনজন অবসরপ্রাপ্ত এবং একজন অতিরিক্ত সচিবের স্ত্রী বলে জানা গেছে।
প্রকল্প পরিচালক আবুল খায়ের মোহাম্মদ হাফিজুল্লাহ খান বলেন, “কোডিং ত্রুটি এত বেশি যে কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বাজেটের বেশিরভাগ শিরোনামই ভুল কোডে আটকে আছে। সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট ইউনিট গড়ে তোলা এ প্রকল্পের অন্যতম বড় লক্ষ্য। এতে থাকার কথা ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ল্যাব, প্রশিক্ষণ ল্যাব, আবহাওয়া বিভাগের সঙ্গে যুক্ত পূর্বাভাস ব্যবস্থা, আরটি পিসিআর মেশিন ও ইনসেক্টেরিয়াম। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভ্যাকসিন গবেষণার জন্য বরাদ্দ আছে ৩০ কোটি টাকা, আর ভেক্টর ব্যবস্থাপনার ১৫টি গবেষণার জন্য ৪০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো বাস্তবায়ন হলে ডেঙ্গু মোকাবিলায় বড় অগ্রগতি আসত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, “ডেঙ্গু মোকাবিলায় এই গবেষণা ও ল্যাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে কাজটি করতে হবে দক্ষ মানুষের হাতে।”
পরিকল্পনা কমিশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের কেউই প্রকল্পে থাকা অসঙ্গতির দায় নিচ্ছেন না। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে যুক্ত ছিলেন পরিকল্পনা বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ড. সারোয়ার বারী। তিনি বলেন, “ডিপিপি কয়েক দফা পর্যালোচনা হয়েছে। এত ভুল থাকার কথা শুনে অবাক হয়েছি।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান মনে করেন, “পুরো প্রকল্পই পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। ডেঙ্গু ভ্যাকসিন গবেষণা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের না হয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে হওয়া স্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন উপাদানে বড় ধরনের অসঙ্গতি আছে। চাইলে সরকার প্রকল্প বাতিলও করতে পারে।”
পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মামুন আল রশিদ মনে করেন, “এটি প্রকল্প পর্যালোচনা কমিটির ব্যর্থতা। পরিকল্পনা কমিশন, এলজিডি, এমনকি বিশ্বব্যাংকও পর্যালোচনা করেছে। এত স্তর পেরিয়েও ত্রুটি ধরা না পড়া উদ্বেগজনক। কঠোর জবাবদিহি না থাকলে এমন ভুল চলতেই থাকবে।”
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কীভাবে এত ভুলে ভরে গেল, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারছেন না। আর সেই ভুল সংশোধনের অপেক্ষায় আটকে আছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার উন্নয়ন উদ্যোগ।