বিদেশ : ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাইয়ের একটি অভিজাত এলাকা ফোর্টের একটি পুরাতন, নব্য-গথিক ভবনে একটি জরাজীর্ণ অফিস রয়েছে। এখান থেকেই দেশটির প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে বিশিষ্ট পার্সি ম্যাগাজিনের মধ্যে একটি ‘পারসিয়ানা’ প্রকাশ করে। ১৯৬৪ সালে পেস্তনজি ওয়ার্ডেন নামে একজন পারসি চিকিৎসক, যিনি চন্দন কাঠের ব্যবসায়ও জড়িত ছিলেন – শহরের সমপ্রদায়ের ইতিহাস বর্ণনা করার জন্য পত্রিকাটি শুরু করেছিলেন। তারপর থেকে পত্রিকাটির গ্রাহক সংখ্যা এবং প্রবাব বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক পারসিদের জন্য, সমপ্রদায়ের মধ্যে কী ঘটছে, তা জানার জন্য ম্যাগাজিনটি একটি জানালা। বিশ্বজুড়ে পারসি সদস্যদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় তাদের সংযুক্তি ও যোগাযোগে সাহায্য করেছে ম্যাগাজিনটি। ৬০ বছর পর গ্রাহক সংখ্যা কমে যাওয়া, তহবিলের অভাব এবং এটি পরিচালনার জন্য কোনো উত্তরসূরি না থাকার কারণে ‘পারসিয়ানা’ এই অক্টোবরে বন্ধ হয়ে যাবে। এই খবরটি কেবল গ্রাহকদেরই নয়, যারা ম্যাগাজিনের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতেন, তাদেরও দুঃখ দিয়েছে। ১৮ বছর বয়সী ছাত্র সুশান্ত সিং বলেন, ‘এটা যেন একটা যুগের সমাপ্তি। আমরা মজা করে বলতাম, তুমি যদি পারসিয়ানা সম্পর্কে না জানো বা এটি সম্পর্কে স্পষ্টবাদী না হও, তাহলে তুমি প্রকৃত পারসি হতে পারো না।’ গত আগস্ট মাসে পত্রিকাটির একটি সম্পাদকীয়তে বন্ধের খবর ঘোষণার পর থেকে শ্রদ্ধা কিংবা সহমর্মিতার ঝড় বইছে। সেপ্টেম্বর সংস্করণে মুম্বাইয়ের একজন পাঠক লিখেছেন, ‘আমাদের মতো এত ছোট সমপ্রদায়কে এত পরিশ্রম এবং আবেগের সঙ্গে বর্ণনা করা যেতে পারে, তা ভাবাও একটি কঠিন প্রচেষ্টা বলে মনে হয়। তবে পারসিয়ানা এই কাজের জন্য পারদর্শী বলে প্রমাণিত হয়েছে।’ পাকিস্তানে বসবাসকারী আরেকজন পাঠক বলেন, ম্যাগাজিনটি ‘একটি প্রকাশনার চেয়েও বেশি কিছু; এটি বিশ্বজুড়ে জরথুস্ত্রীয়দের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী একটি সহচর এবং সেতুবন্ধন।’ ওয়াশিংটন-ভিত্তিক একজন পাঠক ম্যাগাজিনের প্রশংসা করে বলেছেন, ম্যাগাজিনটি বিতর্কিত অনেক বিষয় নিয়ে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিও হাজির করেছে। ১৯৭৩ সালে মাত্র এক টাকায় ম্যাগাজিনটি কিনে নেওয়ার পর থেকে এটি পরিচালনা করে আসছেন ৮০ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর প্যাটেল। তিনি সবসময় চেয়েছিলেন এটি একটি ‘সাংবাদিকতাসুলভ প্রচেষ্টা’ হোক। ওয়ার্ডেন নামের একজন মাসিক ম্যাগাজিন হিসেবে এটি শুরু করেছিলেন। তখন এটি কেবল পারসিদের লেখা বা ওয়ার্ডেনের চিকিৎসা সংক্রান্ত লেখা প্রকাশ করত। দায়িত্ব গ্রহণের পর জাহাঙ্গীর প্যাটেল এটিকে পাক্ষিক পত্রিকায় পরিণত করেন। তখন থেকে ছাপা শুরু হয় প্রতিবেদনধর্মী নিবন্ধ, তীক্ষ্ণ কলাম ও অলঙ্করণ, যেখানে নানান সংবেদনশীল পারসি ইস্যুগুলোকে সততা ও হাস্যরসের সঙ্গে তুলে ধরা হত। তিনি সাংবাদিকদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেন, একটি সাবস্ক্রিপশন মডেল স্থাপন করেন এবং অবশেষে সাদা-কালো জার্নালটিকে রঙিন করে তোলেন। প্যাটেল ম্যাগাজিনের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর প্রথম নিজের গল্পটির কথা স্মরণ করেন। এটি ছিল সমপ্রদায়ের মধ্যে উচ্চ বিবাহবিচ্ছেদের হার সম্পর্কে। তিনি বলেন, ‘পারসিয়ানায় কেউ এরকম কিছু পড়বে বলে আশা করেনি। এটা সমপ্রদায়কে নাড়া দিয়েছিল।’ ১৯৮৭ সালে ম্যাগাজিনটি আন্তঃধর্মীয় বিবাহ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে নতুন যুগ শুরু করে। কঠোর বিবাহ-প্রথার জন্য পরিচিত এই সমপ্রদায়ের মধ্যে এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ ছিল। প্যাটেল বলেন, আগুলো সমপ্রদায়ের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। অনেক পাঠক আমাদের কাছে চিঠি লিখে এই অনুশীলন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমরা তা করিনি। তিনি বলেন, পারসিয়ানা কখনো বিতর্ক থেকে পিছপা হননি, সর্বদা একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে গেছে। বছরের পর বছর ধরে সমপ্রদায়ের ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যা এবং টাওয়ার্স অফ সাইলেন্সের কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো তুলে ধরেছে – এটি এমন একটি জায়গা যেখানে পার্সিরা তাদের মৃতদেহ সমাহিত করে। জার্নালটি সমপ্রদায়ের অর্জন, গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় ঘটনাবলী এবং নতুন পারসি প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসও তুলে ধরে। গত মে মাসে পারসিয়ানা মুম্বাইয়ের আলপাইওয়ালা জাদুঘরের উদ্বোধনের বিষয়টি কভার করেছিল – যা বিশ্বের একমাত্র পারসি জাদুঘর। ম্যাগাজিনের ১৫ সদস্যের কর্মীদলের অনেকেই ষাট এবং সত্তরের দশকের মধ্যে প্যাটেলের অধীনে যোগ দিয়েছিলেন। তারা এখন ম্যাগাজিন এবং তাদের সাংবাদিকতা ক্যারিয়ার উভয়ই শেষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্যাটেল বলেন, ‘বিষণ্ণতার সঙ্গে মিশে থাকা ক্লান্তির অনুভূতি আছে। আমরা অনেক দিন ধরে এটি করে আসছি।’ পুরনো সংস্করণে ভরা অফিসটির রঙ-খোসা ছেড়ে গেছে। ভেঙে পড়া ছাদের কারণে ভবনটির বয়স স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এটি একটি প্রাক্তন পারসি হাসপাতাল, চার দশক ধরে খালি পড়ে আছে। প্যাটেল বলেন, শেষ দিনটির জন্য তাদের কোনো বড় পরিকল্পনা নেই। তবে আসন্ন সংখ্যাগুলোতে পারসিয়ানার দীর্ঘ যাত্রা এবং উত্তরাধিকারকে স্মরণ করে গল্প থাকবে। শেষ দিনটিতে হয়তো তারা অফিসে সবার জন্য দুপুরের খাবার থাকতে পারে। তবে কোনো কেক নয়, কোনো উদযাপন নয়। প্যাটেল বলেন, ‘এটা একটি দুঃখের উপলক্ষ। আমার মনে হয় না আমদের উদযাপনের মতো অনুভূতি থাকবে।’ প্রতিবেদন: বিবিসি