বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা কার্যকর হবে শুক্রবার (১ আগস্ট) থেকে। এ সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক এবং দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নতুন শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে যখন একই সময়ে ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা এগিয়েছে।
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে প্রকাশিত এক চিঠিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এসব তথ্য জানান ডোনাল্ড ট্রাম্প। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে চায়, তবে তা হবে আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য ভিত্তিতে। তাঁর ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বিশ্বের এক নম্বর বাজার এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে বহু বছরের ঘাটতি দূর করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এর আগে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল, যা কার্যকর হয়েছিল ৯ এপ্রিল থেকে। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক টালমাটালে সেই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন ট্রাম্প, যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে মঙ্গলবার (৯ জুলাই)। এর আগেই নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেন তিনি।
চিঠিতে ট্রাম্প উল্লেখ করেছেন, নতুন শুল্কহার কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর গড় শুল্কহার দাঁড়াবে প্রায় ৫০ শতাংশে। এর ফলে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগতে পারে তৈরি পোশাক খাতে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় হয়েছিল প্রায় ৮৪০ কোটি ডলার, যার মধ্যে প্রায় ৭৩৪ কোটি ডলারই ছিল তৈরি পোশাক থেকে।
ট্রাম্পের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শুল্ক এবং অ-শুল্ক নীতি ও বাণিজ্যিক বাধার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তিনি চিঠিতে সতর্ক করেছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যদি পাল্টা কোনো শুল্ক আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রও তার ৩৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে সমান হারে নতুন শুল্ক যোগ করবে। তাঁর বক্তব্য, এই শুল্ক কেবল বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বৈষম্য কমানোর জন্যই নয়, বরং মার্কিন অর্থনীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষার জন্যও প্রয়োজনীয়।
চিঠিতে ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য উৎপাদন করলে কোনো শুল্কই প্রযোজ্য হবে না। এমনকি তিনি জানিয়েছেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে উৎপাদন অনুমোদনের প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত।
এই ঘোষণার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও ট্রাম্পের মন গলানো সম্ভব হয়নি। ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে তিন মাসের জন্য শুল্ক স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হয়েছিল। পাশাপাশি, বাংলাদেশের বাজেটে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়, যার মধ্যে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়।
বিশ্বব্যাপী একাধিক দেশ এই নতুন শুল্কের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে লাওস ও মিয়ানমারের ওপর সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার ওপর ৩৬ শতাংশ, বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ, সার্বিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা এসেছে।
তবে ট্রাম্প আলোচনার দুয়ার পুরোপুরি বন্ধ রাখছেন না। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ১ আগস্টের সময়সীমা চূড়ান্ত নয় এবং যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও ছাড় দিতে রাজি, তাদের প্রতি তিনি নমনীয় হতে পারেন। তাঁর ভাষায়, “পরিস্থিতি বুঝে কিছুটা সমন্বয় করা যেতে পারে… আমরা অবিচার করব না।”
বিশ্বব্যাপী এই নতুন শুল্ক যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারে কতটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে, সেটিই এখন দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।