এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এক আলোচিত মামলায় সাংবাদিক শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে দেওয়া সাত বছরের সাজা বাতিল করে খালাস দিয়েছেন আদালত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এই রায় দিয়েছেন ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শেখ তারিক এজাজ। মঙ্গলবার (২৭ মে) রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন শফিক রেহমান।
এ রায়ে প্রায় নয় বছরের আইনি লড়াইয়ের অবসান ঘটল প্রবীণ এই সাংবাদিকের। রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “এই রায়ের মাধ্যমে দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রমাণ হয়েছে।” প্রধান বিচারপতি, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জুলাই আন্দোলনের বিপ্লবীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
২০১৫ সালের ৩ আগস্ট রাজধানীর পল্টন থানায় মামলাটি করেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমান। অভিযোগে বলা হয়, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের আগে থেকে বিএনপি ও এর জোটভুক্ত দলের নেতারা—বিশেষ করে জাসাসের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন, তার ছেলে রিজভী আহমেদ সিজার এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী কয়েকজন—সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমেরিকায় অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন।
২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সাক্ষ্য দেন সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ১২ জন। এরপর ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নুর শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমানসহ পাঁচজনকে পৃথক দুটি ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেন।
দীর্ঘ সময় যুক্তরাজ্যে অবস্থান করার পর শফিক রেহমান দেশে ফিরে ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আপিলের শর্তে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহবুবুল হকের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তার বিরুদ্ধে থাকা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে এবং সাজার আদেশ স্থগিত করেন।
পরবর্তীতে ২০২৫ সালের ২৭ এপ্রিল আপিলের শুনানি শেষ হয়। সেদিনই রায় ঘোষণার জন্য ২৭ মে দিন ধার্য করা হয়। নির্ধারিত তারিখে শুনানি শেষে আদালত শফিক রেহমানকে খালাস দেন।
রায় ঘোষণার দিন সকালে আদালতে উপস্থিত হন শফিক রেহমান। প্রবীণ এই সাংবাদিক একা হাঁটতে অক্ষম থাকায় আইনজীবীদের সহায়তায় দ্বিতীয় তলায় ওঠেন। রায় শোনার পর আদালত চত্বরেই সাংবাদিকদের উদ্দেশে লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন।
তিনি বলেন, “সুদীর্ঘ ৯ বছর পরে সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই বিচারকবৃন্দকে, যাঁরা স্বাধীনভাবে এই রায় দিয়েছেন।” তিনি কৃতজ্ঞতা জানান প্রয়াত আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী ও সানাউল্লাহ মিয়া, সহধর্মিণী তালেয়া রেহমান এবং ছেলে সুমিত রেহমানের প্রতি।
শফিক রেহমান বলেন, “আমার ছেলে লন্ডনে কয়েক হাজার ব্রিটিশ ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আমার মুক্তির দাবি জানিয়েছিল। আর আমার স্ত্রীও এই সময় অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছেন, যদিও এখন লন্ডনে চিকিৎসাধীন।”
তিনি শ্রদ্ধা জানান ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের শহিদদের ও জুলাই আন্দোলনের বিপ্লবীদের প্রতিও, যাদের আত্মত্যাগের ফলেই তার ভাষায়—“আজ সত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।”
শফিক রেহমান সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। পরে এটি দৈনিক আকারে প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ‘লাল গোলাপ’ নামে তুমুল জনপ্রিয়তা পান তিনি। লেখক, সম্পাদক, অনুষ্ঠান উপস্থাপক এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবেও তার পেশাগত পরিচিতি রয়েছে।
২০১৬ সালে মামলাটিতে গ্রেপ্তারের পর পাঁচ মাস কারাভোগ করেন তিনি। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান। ছয় বছরের প্রবাস শেষে ২০২৩ সালের ১৮ আগস্ট দেশে ফিরে পুনরায় দৈনিক যায়যায়দিন-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন শুরু করেন।