২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে রমনা বটমূলে ঘটে যায় এক ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। প্রাণ হারান ১০ জন, আহত হন বহু নিরীহ সংস্কৃতিপ্রেমী। সেই ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় দীর্ঘ ২৩ বছর পর মঙ্গলবার চূড়ান্ত রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।
এ হামলায় জড়িত সন্দেহে যাদের বিচার হয়েছিল, তাদের মধ্যে বিচারিক আদালত ২০১৪ সালে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। তবে হাইকোর্ট সম্প্রতি সেই রায়ের পর্যালোচনা শেষে সাজা কমিয়ে দিয়েছে। নতুন রায়ে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে দুইজন—মাওলানা তাজউদ্দিন ও শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল—পেয়েছেন যাবজ্জীবন সাজা, আর বাকি নয়জনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণায় বলেন, “রমনা বটমূলে হামলাটি ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) পরিকল্পিত হামলা, যা ছিল দেশের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার ওপর সরাসরি আঘাত। এটি একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড, ‘ব্রুটাল মার্ডার’, যার মাধ্যমে মৌলবাদী গোষ্ঠী জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল।”
হামলার দিনই দায়ের হয় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুটি মামলা। প্রায় আট বছর পর, ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর, সিআইডি ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এরপর সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রুহুল আমিন রায় দেন। এই রায়ে হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ আটজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
তবে এর মধ্যে মুফতি হান্নানের ফাঁসি অন্য মামলায় (সিলেটের ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী হত্যা মামলা) ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। এছাড়া আসামিদের মধ্যে আব্দুর রউফ ও ইয়াহিয়া হাইকোর্টে আপিল শুনানির আগেই মারা যান, ফলে তাঁদের আপিল পরিসমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
কার সাজা কীভাবে কমেছে?
• মুফতি আবদুল হান্নান: এই মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড হলেও, অন্য মামলায় (সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা) তার ফাঁসি ইতোমধ্যে কার্যকর হওয়ায় এই মামলায় তার আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে।
• মাওলানা মো. তাজউদ্দিন: আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন, হাইকোর্টে তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
• আকবর হোসেন, আরিফ হাসান সুমন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুফতি আবদুল হাই ও মাওলানা শফিকুর রহমান—এরা সবাই আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। হাইকোর্ট তাদের মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে প্রত্যেককে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন।
• শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল: আগে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন, হাইকোর্ট তার দণ্ড অবিকল বহাল রেখেছেন।
• হান্নান সাব্বির, শেখ ফরিদ ওরফে শওকত ওসমান, আবু তাহের—এই তিনজন আগে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। হাইকোর্ট তাদের সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন।
• আব্দুর রউফ ও ইয়াহিয়া: তারা বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হলেও হাইকোর্টে আপিল শুনানি চলাকালে মারা যান। তাই তাদের আপিল পরিসমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
এই মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স নানা জটিলতা ও বেঞ্চ পরিবর্তনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল। অবশেষে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় রায় পড়া। ৮ মে আংশিক রায় ঘোষণার পর ১৩ মে পুরো রায় ঘোষণা করা হয়।
https://www.kaabait.com