আন্তর্জাতিক ফুটবলে নারী ফুটবলাররা রং ছড়িয়েছেন

0
22

স্পোর্টস: ফুটবল যে সংকটের জালের মধ্যে ঢুকে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, সে অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য দরকার সমন্বিত সাধারণ সূত্র। অথচ সেখানে বিভাজন, রেষারেষি, প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব, ঘোলা পানিতে ব্যক্তি ও সমষ্টির এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মাঠের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ তর্ক ও আলোচনার খেলা চলছে মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সাধারণ মহলে। বর্তমান সংকট নিয়ে নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্টরা অপরিপক্বতা ও বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলছেন। ফুটবল ফেডারেশন তো সবার, এটি কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টির নয়। সচেতন মহল জানে ফুটবলে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বে সম্মিলিতভাবে কাজ হয় না। অযৌক্তিক অনেক কিছুই ফুটবলে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। এক প্যানেলে নির্বাচন করে জয়ী হয়েও একে অপরের বিরোধিতা করে। ফুটবলের প্রধান খলনায়ক হচ্ছে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং অনৈক্য। এ অবস্থা বহু বছর ধরে চলে আসেছ। এ ক্ষেত্রে দুর্বলতা লক্ষণীয় হলেও তা সুরাহা হয়নি। দেশের ফুটবলের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন একপশলা বৃষ্টির মাধ্যমে পেয়েছে সাময়িক স্বস্তি! পেরেছে হাঁফ ছাড়তে। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এএফসি এশিয়ান কাপের ডি গ্রুপের খেলায় আমাদের অনূর্ধ্ব-১৭ নারী দল দাপটের সঙ্গে খেলে (তুর্কমেনিস্তানকে ৬-০ এবং ৩-০ গোলে সিঙ্গাপুরকে পরাজিত করে) অপরাজিত থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে। বাছাই পর্বে ৮ গ্রুপে অংশ নিয়েছে ২৯টি দেশ। প্রতি গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন দল দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে। আগামী ১৬-২৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা। দ্বিতীয় রাউন্ডের দুই গ্রুপের দুই চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ দল আগামী বছর ৭-২০ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠেয় চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পাবে। স্বাগতিক ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৬ এশিয়ান কাপের শীর্ষ তিন দল জাপান, চীন ও উত্তর কোরিয়া সরাসরি খেলবে। এর আগে অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলে বাংলাদেশ দুবার চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে। সেই অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্ট এখন অনূর্ধ্ব-১৭। নারী দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় একধরনের অস্বস্তিকর আলোচনায় সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ছেদ পড়ছে। প্রসঙ্গ পাল্টেছে। আত্মবিশ্বাসী অনূর্ধ্ব-১৭ নারী দল মাঠের চ্যালেঞ্জে জিতেছে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আবার রং ছড়িয়ে দেশের পতাকাকে সমুন্নত করেছে। আক্রমণাত্মক এবং গোছানো ফুটবল খেলার মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে ‘আমরাও পারি’। দেশ ছাড়ার আগে জয়ের ক্ষুধায় ভোগা আত্মবিশ্বাসী দলটির পক্ষে কোচ গোলাম রাব্বানী বলেছেন, মেয়েরা জয় ছাড়া আর কিছু ভাবছে না। তারা মাঠে লড়াই করে চ্যাম্পিয়ন হয়েই দেশে ফিরে আসবে। সুলতানা, সুরভী, থুইনু, রুমারা সবাই মিলে খেলে দেশের মানুষকে জয়ের স্বাদ দিয়েছে। জয়ের মাধ্যমে আবার আবেদন জানিয়েছে তাদের ওপর বিশ্বাস এবং আস্থা রাখতে। দেশের মানুষের জন্য ফুটবল নিছক একটি খেলা নয়, খেলার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। ফুটবলে জয়কে সবাই একসঙ্গে উপভোগ করেন। কোচ গোলাম রাব্বানী বলেছেন, ‘মনোযোগ প্রতিভাকে হরহামেশাই হার মানায়। নিরবচ্ছিন্ন মনঃসংযোগ ধরে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। মেয়েরা আনন্দ নিয়ে ফুটবল খেলেছে। ফুটবল উপভোগ করেছে। বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলারদের মধ্যে ড্রিবলিং, পাসিংয়ে দক্ষতা, ম্যাচের গতি-প্রকৃতি বোঝা, প্রতি-আক্রমণ তৈরির ক্ষমতা বেড়েছে! ম্যাচ জেতার জন্য প্রয়োজন শক্ত মানসিকতা। এই মানসিকতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে। মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে, ওরা বুঝতে পারছে আক্রমণভাগ ম্যাচ জেতাবে। রক্ষণভাগ জেতাবে শিরোপা।’ ফুটবল ফেডারেশন তো আন্তর্জাতিক ফুটবলে অন্ধের যষ্ঠি নারী ফুটবল। বাফুফের শোকেসে তো নারী ফুটবলারদের অর্জিত ট্রফি প্রদর্শিত হচ্ছে। দেশের ফুটবলের নদীকে বাঁচিয়ে রেখেছে নারী ফুটবল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নারী ফুটবলের মুকুট তো এখন বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের মাথায়। অথচ নারী জাতীয় দলকে ফুটবল ফেডারেশন মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকের বাছাই পর্বে অর্থের টানাপড়েনের দুর্বল নাটক সৃষ্টি করে পাঠায়নি। বাফুফে চেয়েছিল ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’র পদ্ধতি অবলম্বন করে সরকার এবং বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট মহলের নজর কাড়তে। কিন্তু তাদের এই কূট চেষ্টা ‘বুমেরাং’ হয়েছে। ভীষণ কাঁচা কাজ করে ‘ফেঁসে’ গেছে বাফুফে। তারা বুঝতে পারেনি সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের নেতিবাচক উদ্যোগটি ভীষণভাবে সমালোচিত এবং নিন্দনীয় হবে। ফুটবলে বহু রকম অনৈতিকতার কার্যকলাপের মধ্যে এটি আরেকটি। এটি স্পষ্টভাবে জনগণের মনোভাব উপেক্ষা করা, যেটি উচিত হয়নি! ফুটবল ফেডারেশন ‘শাক দিয়ে মাছ’ ঢাকার অনেক কৌশল অবলম্বন করে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে তাদের ভুল স্বীকার করেছে। দুঃখ প্রকাশ করেছে। প্রচলিত ধারায় আশ্বাস দিয়েছে আগামীতে নারী ফুটবলে তারা অনেক বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে। দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের অভাবে খেলাটি সংকটের জালের মধ্যে ঢুকে হাবুডুবু খাচ্ছে, এটি সবাই লক্ষ করছেন। ফুটবলে এই সমস্যা ১৪-১৫ বছর ধরে নয়, আরো অনেক আগে থেকে। সেই নব্বইয়ের পর থেকে ফুটবলকে ঘিরে বছরের পর বছর ধরে যে খেলা চলছে তাতে সংগঠকরা কে কতটুকু জিতেছেন, কার কতটুকু স্বার্থ হাসিল হয়েছে, কে কিভাবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন এসব কিছু এক পাশে সরিয়ে এনে বলা যায়, মাঠের ফুটবল কিন্তু বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের ফুটবলের জাতীয় স্বার্থ বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। মেয়েরা চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন। ফুটবলকে ঘিরে তাঁদের স্বপ্ন বড় হচ্ছে। নারী ফুটবলাররা অনেক পরিশ্রম আর সামাজিক বাধা-নিষেধের বিপক্ষে লড়াই করে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এখন এই উচ্চতায় পৌঁছেছেন। আর এই উচ্চতায় পৌঁছা তাঁদের দায়িত্ব নারী ফুটবলাররা বোঝেন। জাতীয় দলের সুযোগ ছিল অলিম্পিক বাছাইয়ে খেলার। এই অভিজ্ঞতা তাঁদের কাজে লাগত। ফেডারেশন অপেশাদারি কাজটি করে নারী ফুটবলের ক্ষতি করেছে। একসময় মেয়েদের স্বপ্ন ছিল ছোট। সময়ের সঙ্গে তাঁদের স্বপ্নের রং ও রূপ বদলেছে। নারীরা ফুটবলে সংগ্রামের মাধ্যমে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী এবং উচ্চাকাক্সক্ষী। তাঁরা জানেন ফুটবলে তাঁদের লক্ষ্য কী! জানেন কিভাবে সেই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছনো সম্ভব হবে। নারী ফুটবলাররা পুরুষশাসিত ক্রীড়াঙ্গনে শুধু সহায়তা চান। চান সমাজ ও দেশের কাছে ‘প্রটেকশন’ তাদের সাধারণ প্রতিভা বিকাশ এবং সেই প্রতিভাকে কাজে লাগানোর জন্য। লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস, এশিয়া।