বিদেশ : ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার শিল্পী সমাজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। যারা ইউক্রেনে রুশ অভিযানকে সমর্থন করেন, তারা পাচ্ছেন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। কিন্তু যারা এর বিপক্ষে তাদের ওপর এখন তৈরি হয়েছে প্রচ- চাপ, যাতে তারা তাদের কাজে সরকারি লাইন অনুসরণ করে চলেন। রাশিয়াতে মুখ খুললে আপনাকে দিতে হতে পারে চরম মূল্য। আপনি হয়তো খুন হয়ে যাবেন, নয়তো আপনার জেল হবে, বা দেশ ছেড়ে নির্বাসনে যেতে হবে। আর আপনি যদি সংস্কৃতি জগতের লোক হন, তাহলে হয়তো আপনাকে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম বা অনুষ্ঠান থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হবে। আন্দ্রেই ম্যাকারেভিচ হচ্ছেন এমনি একজন। তিনি ‘মাশিনা ভ্রেমেনি’ নামে একটি রক গ্রুপের গায়ক ছিলেন এবং রাশিয়ার সবচেয়ে সুপরিচিত পারফর্মারদের একজন। ভøাদিমির পুতিনের রাশিয়ায় সরকারের নীতির সমালোচনা করার পর তিনি এখন পরিত্যক্ত এক শিল্পী। আন্দ্রেই ম্যাকারেভিচের উত্থান হয়েছিল সোভিয়েত যুগে। মিখাইল গরবাচেভের সংস্কারের পর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টিভিতে একসময় তাকে বলা হতো পেরেস্ত্রোইকার বীটল। কিন্তু ম্যাকারেভিচ ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন কড়া সমালোচক। রাশিয়া যখন ২০১৪ সালে প্রথমবার ইউক্রেনে অভিযান চালায়, তখন ম্যাকারেভিচ একটি গান লিখেছিলেন, ‘আমার দেশ পাগল হয়ে গেছে।’ সে সময় যুদ্ধ-বিরোধী সমাবেশগুলোতেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তার পরে যা হলো, রাশিয়ার নানা প্রান্তে ম্যাকারেভিচের অনেকগুলো অনুষ্ঠানে একে একে বাতিল হয়ে গেল। ম্যাকারেভিচ অভিযোগ করলেন, ক্রেমলিন তাকে হয়রানি করার এক অভিযানে নেমেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে যখন রাশিয়া-ইউক্রেন পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হলো, তখন ম্যাকারেভিচের এক বিরাট মোহভঙ্গ হলো। তিনি রাশিয়া ছাড়লেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করাটা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। লোকে এখন অনেক বেশি অজ্ঞ এবং আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে।’ নিকোলাই রাস্টোরগায়েভ, ‘পুতিনের প্রিয় ব্যান্ডের’ গায়ক এর বিপরীত মেরুতে আছেন নিকোলাই রাস্টোরগায়েভ। যিনি রাষ্ট্রের আনুকুল্যপ্রাপ্ত একজন শিল্পী। লিউব নামে একটি গ্রুপ, যাকে প্রায়ই বর্ণনা করা হয় ‘পুতিনের প্রিয় ব্যান্ড’ বলে, তার লিড গায়ক তিনি। তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার নীতি ও ‘বিশেষ সামরিক অপারেশনের’ একজন উচ্চকণ্ঠ সমর্থক। ম্যাকারেভিচ রাশিয়ায় অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাননি, কিন্তু রাস্টোরগায়েভ দেশটির সেরা সব মঞ্চে বছরের পর বছর ধরে সহজেই অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাচ্ছেন। মস্কোতে ২০১৪ সালের ১৫ই মার্চ একটি শান্তি মিছিলের পর ইউক্রেন বিরোধী কর্মীদের হাতে ম্যাকারেভিচের মার খাবার উপক্রম হয়েছিল। সেই দিনই রাজধানীর অলিম্পিক স্টেডিয়ামে লিউব তাদের ২৫তম বার্ষিকী উদযাপন করে। তার পরদিনই রাস্টোরগায়েভের ব্যান্ড ক্রিমিয়াতে একটি অনুষ্ঠান করে। অনুষ্ঠানটি ছিল সেখানে এক ভোটের সমর্থনে, যেটি কোন আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়নি। কিন্তু ক্রেমলিন তা ব্যবহার করেছিল ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গীভূত করে নেবার বৈধতা পাবার জন্য। রাস্টোরগায়েভ ও তার ব্যান্ড রাশিয়ার সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম লুঝনিকিতেও অনুষ্ঠান করেছেন। ক্রেমলিনের আয়োজিত সেই গণসমাবেশে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও। অধিকৃত ক্রিমিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী সেতুর উদ্বোধনকে নিয়ে লিউব একটি গানও রচনা করেছে। এই ব্যান্ডটির প্রভাব কতখানি তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। রাজনৈতিক বিরোধীদের সন্ধানে মস্কোর একটি বারে পুলিশ অভিযান চালিয়েছিল। সেখানে বারের মালিকরা যে সরকারের সমর্থক তার প্রমাণ হিসেবে পুলিশ তাদের লিউবের একটি গান গাইতে বাধ্য করেছিল। নিকোলাই রাস্টোরগায়েভের ওপর এখন ইইউর নিষেধাজ্ঞা আছে। ‘ক্রেমলিনের ভুয়া তথ্য ও তথ্য বিকৃতির’ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার কারণে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ম্যাকারেভিচের মতো অসংখ্য শিল্পী যারা ক্রেমলিনের সমালোচক, তাদেরকে সরকারিভাবে ‘বিদেশী এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ফিল্ম ও থিয়েটার : রাশিয়ার সিনেমা ও থিয়েটার জগতের তারকাদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে এক গভীর বিভক্তি। নিকিতা মিখালকভ হচ্ছের রাশিয়ার সবচেয়ে নন্দিত অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালকদের অন্যতম। তার অভিনীত ও পরিচালিত ‘বার্নট বাই দ্য সান’ ১৯৯৪ সালে অস্কার জয় করে। সোভিয়েত নেতা স্টালিনের সময়কার ত্রাসের রাজত্বে ক্ষতবিক্ষত মানুষদের জীবন নিয়ে তৈরি এই ছবিটি। মিখালকভের চিন্তাভাবনা ক্রেমলিনের সরকারি আদর্শের খুবই কাছাকাছি। তিনি একজন ধার্মিক রক্ষণশীল এবং তার মতাদর্শ চরমভাবে পশ্চিমা-বিরোধী। তিনি ‘বেসোগন’ নামে একটি টিভি অনুষ্ঠান করেন। যা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয় এবং তার দর্শকদের মধ্যে ভøাদিমির পুতিনও আছেন। এ অনুষ্ঠানে তিনি পশ্চিমা বিরোধী ষড়যন্ত্র তত্ত্বও শেয়ার করেছেন। মিখালকভ প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। ২০০৭ সালে তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে পুতিনকে একটি খোলা চিঠি লেখেন। যাতে তাকে সংবিধান লঙ্ঘন করে তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে থাকার আহ্বান জানানো হয়। ওই একই বছর মিখালকভ পুতিনের ৫৫তম জন্মদিন উপলক্ষে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন যা সেই দিনেই রাষ্ট্রীয় টিভিতে দেখানো হয়। মিখালকভ ১৯৯৭ সাল থেকে রাশিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ইউনিয়নের নেতা। তিনি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদক ও অনুদান পেয়েছেন। এর মধ্যে আছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া ‘পিতৃভূমির শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য পুরষ্কার’। তাছাড়া বার্নট বাই দ্য সান ছবিটির একটি দ্বিতীয় পর্ব নির্মাণের জন্যও তিনি ২০ লাখ ডলারের রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন পেয়েছেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার ২০২২ সালের অভিযানকেও সমর্থন দিয়েছেন মিখালকভ। রুশ প্রেসিডেন্ট যেসব কথা বলে থাকেন, যেমন ‘ইউক্রেন শাসন করছে একটি নাৎসি চক্র’ এবং ‘ইউক্রেনীয় ভাষাটি হচ্ছে রাশিয়ার প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ’ হুবহু এসব কথা মিখালকভকেও বলতে শোনা যায়। ইউক্রেনে অভিযান শুরুর কয়েক মাস পরই পুতিন ক্রেমলিনে এক অনুষ্ঠানে মিখালকভকে ‘হিরো অব লেবার’ উপাধিতে ভূষিত করেন। প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ দিয়ে মিখালকভ বলেন, ‘ইউক্রেনে যে যুদ্ধ হচ্ছে তার মাধ্যমে সেখানে এক নতুন রাশিয়ার সূচনা হচ্ছে।’ “ক্রেমলিনের প্রচারণা” ছড়ানোর ক্ষেত্রে তার ভূমিকার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন মিখালকভের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
ভিন্নমতাবলম্বী লিয়া আখেদঝাকোভা : অভিনেত্রী লিয়া আখেদঝাকোভার রাজনৈতিক মতাদর্শ একেবারেই ভিন্ন ধরনের। এ কারণে তার কেরিয়ারও ভিন্ন পথে এগিয়েছে। তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ১৯৭০ এর দশকে। সে সময় কয়েকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সোভিয়েত সিনেমা যেমন, “দি আয়রনি অব ফেট” এবং “অফিস রোমান্স” এ তার ভূমিকার পাশাপাশি মস্কোর অন্যতম সেরা থিয়েটার সুভ্রেমেনিকে তার অনেকগুলো অভিনয় তাকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর থেকে লিয়া তার রাজনৈতিক মতামত খোলাখুলি প্রকাশ করতে কখনোই কুণ্ঠিত হননি। তিনি প্রায়ই সরকারের নীতির কড়া সমালোচনা করতেন। মস্কোতে ২০১৪ সালে এক সমাবেশে লিয়া ইউক্রেনের ‘ইউরোময়দান’ নামের বিক্ষোভের প্রশংসা করেন। ওই বিক্ষোভের ফলে তৎকালীন রুশপন্থী ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং রাশিয়া প্রথমবার ইউক্রেনে অভিযান চালায়। মস্কোর সেই সমাবেশে লিয়া আখেদঝাকোভা কিয়েভের নিহত গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের প্রতি সম্মান জানাতে আহ্বান জানালে জনতা তার সমর্থনে শ্লোগান দিতে থাকে। তবে সেই ঘটনার আট বছর পর যখন ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান চালালেন, তখন কিন্তু রাশিয়ায় এ ধরনের সমাবেশের কথা অকল্পনীয় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু লিয়া আখেদঝাকোভা রুশ অভিযান শুরুর দিনেই স্বাধীন ডঝড টিভি চ্যানেলে তার সহশিল্পী ও বিশিষ্টজনদের প্রতি আহ্বান জানালেন এ যুদ্ধের বিরোধিতা করতে। তিনি বলেন, ‘আমি সংস্কৃতি জগতের সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, মুখ খোলার সময় এসেছে। আমাদের কথা বলতেই হবে, কারণ আমরা আরেকটি সুযোগ আর পাবো না। একটি যুদ্ধ হচ্ছে, আর অসংখ্য মিথ্যার পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে।’ এ ঘটনার এক সপ্তাহ পার না হতেই ডঝড টিভি তাদের কার্যক্রম বিদেশে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়। এর কারণ ছিল ক্রমাগত কঠোর হতে থাকা সেন্সরশিপ এবং তাদের কর্মীদের ব্যাপারে উদ্বেগ। এক বছর পর লিয়া আখেদঝাকোভা সুভ্রেমেনিক থিয়েটারে তার কাজটি হারান। যার সঙ্গে তিনি ৪৫ বছর ধরে জড়িত ছিলেন। আরেকটি ব্যাপারও স্টালিন যুগের কথা মনে করিয়ে দেয়। সম্প্রতি একজন সরকারপন্থী কর্মী কৌঁসুলিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘লিয়া আখেদঝাকোভা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন কিনা, তা যেন তারা যাচাই করে দেখেন।’