স্বাস্থ্য: মানবদেহের এ অংশের ক্যান্সারের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক এবং জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ওর্যাল ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. নাদিমুল হাসান।
ওরাল ক্যাভিটি ক্যান্সার কী বুঝায়?
অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক: ওরাল ক্যাভিটির আভিধানিক বাংলা অর্থ হলো মুখ বা মুখগহ্বরের ক্যান্সার। মুখগহ্বরের যে বিভিন্ন অংশ আছে সে অংশের কোনো এক জায়গায় যে ক্যান্সারগুলো সৃষ্টি হয় তাকেই ওরাল ক্যাভিটি ক্যান্সার বলা হয়। মুখগহ্বরকে আমরা প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। সামনের অংশকে আমরা বলি মুখগহ্বরের সামনের অংশ বা ওরাল ক্যাভিটি প্রপার আর পেছনের অংশকে বলি ওরোফ্যারিংক্স। মুখের যেসব অংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় বেশি সেগুলো হলো ঠোঁট, জিহ্বা, গালের ভেতরের অংশ, মাড়ি, মুখের শক্ত ও নরম তালু, গলার নিচের অংশ।
কী কী ধরনের মুখের ক্যান্সার হয়ে থাকে?
ডা. নাদিমুল হাসান: মুখের ক্যান্সার মূলত ৯৯ ভাগই স্কোয়ামাশ সেল কারসিনোমা। মুখের ক্যান্সারের মধ্যে বেশি দেখা যায় ঠোঁট, জিহ্বা, গালের ভেতরের অংশ, মাড়ি ও মুখের তালুর ক্যান্সার।
মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ কী?
ডা. নাদিমুল হাসান: লক্ষণ হচ্ছে প্রথমে একটা অস্বাভাবিক ব্যথাহীন মাংশপি- দিয়ে শুরু হতে পারে, ঘা হতে পারে যেটা সহজে সারছে না, ঢোক গিলতে ব্যথা অনুভূত হয়, কথা বলতে অসুবিধা হয়, জিহ্বা নাড়াতেও সমস্যা হতে পারে।
মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পেলে করণীয় কী?
অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক: কোনো মানুষের যদি এমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় প্রথমেই একজন রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক প্রাথমিক কিছু পরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরু করবেন। তাতে যদি সাত দিনে কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে ওই চিকিৎসকই কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে রোগীকে পাঠাবেন।
ধূমপানই মুখের ক্যান্সারের একমাত্র কারণ?
অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক: আমরা ধূমপানকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করে থাকি। একটি ধোঁয়াবিহীন ধূমপান এবং অন্যটি ধোঁয়াসহ ধূমপান। আমাদের দেশের প্রায় মানুষই পান খেয়ে থাকে। কখনো কখনো তারা পানকে দাঁতের এক পাশে জমা রাখে ফলে দাঁতে ক্রনিক ইরিটেশন হয় এবং গর্ত তৈরি হয়ে পরবর্তীতে এখানেও ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। এর সাথে ধূমপানও মুখের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। যখন এই দুইটায় একজন মানুষ করে তখন মুখের ক্যান্সারের আশঙ্কা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
আমাদের দেশে মুখের ক্যান্সারের ভয়াবহতা কতটুকু?
ডা. নাদিমুল হাসান: আমাদের দেশে মুখের ক্যান্সার পুরুষদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় এবং নারীদের ক্ষেত্রে তৃতীয়। তবে কিছুদিন আগেও দেশে এত ভয়াবহ ছিল না। এর মূল কারণ হচ্ছে- ধূমপান ও পানের সহজলভ্যতা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় মুখের ক্যান্সার দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। পশ্চিমা বিশ্বে মুখের ক্যান্সারের হার ৬-৭ শতাংশ কিন্তু বাংলাদেশে এ পরিসংখ্যান ৩০ শতাংশের কম না।
মুখের ক্যান্সার শনাক্তকরণে কী কী পদ্ধতি রয়েছে?
ডা. নাদিমুল হাসান: এ ধরনের ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য প্রথমে আমরা সরাসরি দেখে, এটার অবস্থান ও গতিবিধি নির্ধারণ করে থাকি। এরপর যদি সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে পরবর্তীতে আমরা একটি বায়োপসি করি, সেক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থান থেকে এক টুকরো মাংস নিয়ে আমরা হিস্টোপ্যাথলজিতে দেখি এটা আসলে কী? তখনই ক্যান্সার থাকলে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। ক্যান্সার ধরা পড়লে পরে আমরা আরো কিছু পরীক্ষা করি। ক্যান্সার কতটুকু ছড়িয়েছে সেটি দেখার জন্য এক্স-রে করি, আরো গভীরতা বুঝতে সিটি স্ক্যান, এম আর আইও করে থাকি আমরা। এর মাধ্যমে ক্যান্সারের পর্যায় নির্ধারণ করা সম্ভব।
কোন পর্যায়ে মুখের ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে আমাদের দেশে?
ডা. নাদিমুল হাসান: মুখের ক্যান্সার আসলে আমরা খুব প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারছি না। একটা পরিসংখ্যানে আমরা দেখেছি বাংলাদেশ ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যেসব রোগী মুখের ক্যান্সার নিয়ে আসছেন তাদের ৭৫ ভাগই অ্যাডভান্স স্টেজে আসছেন। অর্থাৎ ক্যান্সারের যে চারটি ধাপ আছে ১, ২, ৩, ৪। আমরা প্রথম দুই ধাপে খুবই কম রোগী পেয়ে থাকি। সাধারণ ঘা নিয়ে মানুষ চিকিৎসকের কাছে আসছে না, যখন এটি মারাত্মক রুপ ধারণ করে তখন আসছে কিন্তু তখন দেখা যায় ক্যান্সার ইতোমধ্যে তৃতীয় বা চতুর্থ ধাপে আছে। সেসময় চিকিৎসাটাও আসলে জটিল হয়ে পড়ে।
প্রথম পর্যায়ে যে শনাক্ত করা যাচ্ছে না এজন্য কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে?
অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক: আসলে প্রথমে রোগীরা যে প্রাথমিক পর্যায়ে কেন চিকিৎসকের কাছে আসছে না এটারও একটা কারণ আছে। কারণ ক্যান্সার বা ম্যালিগনেন্সির আলাদা করে কোনো ব্যথা থাকে না ফলে রোগী মনে করে ব্যথা নাই তো আমি ভালো আছি তাই আর চিকিৎসকের কাছে যান না। তবে আমার মনে হয় প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণের জন্য আমাদের চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল স্ক্রিনিং করা উচিত। উন্নত বিশ্বে থাকলেও আমাদের দেশে এখনো চালু হয়নি। তবে আশা করা যায় আমাদের দেশেও খুব শিগগিরই চালু করা হবে। এজন্য রোগীদের উদ্দেশ্যে বলবো রোগীরা যাতে সপ্তাহে অন্তত একদিন আয়নায় নিজের মুখ দেখেন এবং কোনো সমস্যা মনে হলেই সাথে সাথে যেনো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়।
শনাক্তের পর্যায় অনুযায়ী সুস্থতার সম্ভাবনা কতটুকু?
অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক: মুখের ক্যান্সার যদি প্রথম পর্যায়ে শনাক্ত করা যায় তাহলে সুস্থতার সম্ভাবনা শতভাগ। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে শনাক্ত হলে সম্ভাবনা থাকে ৮০-৯০ ভাগ। তবে তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেলেই সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকে ৪০-৬০ ভাগ। কিন্তু যখনই চতুর্থ পর্যায়ে চলে আসে তখন সুস্থতার হার কমে আসে ১০-২০ ভাগে। কিছু ক্ষেত্রে এর হার ৫ ভাগেও নেমে আসতে পারে।
মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি কী রয়েছে?
অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক: যেকোনো ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতিই হলো ৩টি। ১. সার্জারি বা শৈল চিকিৎসা, ২. রেডিয়েশন বা বিকিরণ চিকিৎসা ও ৩. থেরাপি (কেমো ও ইমিউনো) চিকিৎসা।
সবশেষে সবার জন্য পরামর্শ দেন এই দুই চিকিৎসক। তারা বলেন- ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। তাই সবার আগে প্রয়োজন নিজের সচেতনতা। সপ্তাহে অন্তত একদিন আয়নায় নিজের মুখ-দাঁত দেখে সমস্যা নির্ণয় করতে পারেন। আর প্রতি ছয় মাস পর পর অন্তত একবার একজন ডেন্টিস্টের কাছে চেকআপ করে নিতে পারেন। আর সাধারণভাবে দাঁতের যতœ নিন, সুস্থ থাকুন।