মুস্তাক মুহাম্মদ
সবুজ শামীম আহসান একজন কবি , কণ্ঠশিল্পী ও আলোচক । পেশা অধ্যাপনা। যশোর জেলার বিভিন্ন সাহিত্য আলোচনার অনুষ্ঠানে তার মণীষাদৃপ্ত বক্তব্য সাহিত্যমনাদের সমৃদ্ধ করে। তেমনি তাঁর কবিতা আমাদের মননকে পরিশীলিত করে। একজন কবি তার সমকালকে ধারণ করে। সমকালে তথা তার সময়ে সে আধুনিক । এই আধুনিক সময়ে সে ধারণ করে তার সময়ে ঘটিত ঘটনা – আচার – কালচার – সংস্কৃতি । কবি তার সংস্কৃতির ধারক বাহক । কবি যেমন সুন্দরের পূূজারী তেমনি সত্যর সাধকও বটে । তবে সে অন্যায়ের মৃত্যুদূত। তার কলমে উঠে আসে সময় । কবি সব সময় পবিত্র সত্ত্বার ধারক । তার সময়ে পৃথিবীতে যত শুভ কাজ হচ্ছে কবি তার সমর্থন করে। আর যত জুলুম তথা অন্যায় কাজ হয় কবি তার বিরোধী । এই বিরোধীতা করতে গিয়ে অনেক সময় ক্ষমতাশীন পেশীর আচড় কবি জীবনকে বিপন্ন করতে চাই। কিন্তু কবি সাহসী সৈনিকের মত আমৃত্য যুদ্ধ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সমকালকে ধারণ করা কবি অসুন্দরকে সুন্দর করার পথ বাতলে দিয়ে অগ্র সৈনিক হিসেবে সামনে থাকেন । কবি সবুজ শামীম আহসান তার সমকালকে এভাবে প্রকাশ করেছেন “ যে আঁধারে আলোর মেলা ” কাব্যগ্রন্থে।
“ বিবেকের বোধ ” কবিতায় তিনি লিখেছেন “ দিনে – রাতে মাঠে – ময়দানে সত্যের মুখে ঘোমটার / পরোয়ানা জারি। /চেতনার উপন্যাসে ট্রাপিক জ্যাম। গোপন গুহায় বন্দি বিবেকের বোধ। / কেবল ক্রীতদাসের পথে ক্ষমতার বিহিসেবি বাঘ। / পরাশক্তির কাছে পরাধীন পাখি।/#/ ওদিকে হাসপাতালে গয়া – কাশি ভিড় / ভিখারির থালার মতো কতিপয় ডাক্তারি হাত।”
মানুষের বিবেক বোধ আজ প্রায় লুপ্ত । চেতনাধারী মানুষের সংখ্যা খুবই কম । স্বার্থের নেশায় মানুষ আজ অন্ধ । পেশিশক্তি তথা ক্ষমতাশীনদের কাছে মানুষ এত নতজানু যে আজ সে অস্তিত্বহীন । মানুষ বিবেক থাকার কারণে শ্রেষ্ঠ কিন্তু আজ বিবেক বোধ মানবিকতা সমাজে দুষ্প্রাপ্য । সব কিছু আজ নতজানু ; ক্ষমতার ঘোড়ার পা চাটা চাটুকার। ওদিকে আর্থিক লাভবান হবার অন্ধ নেশায় ডুবে যাচ্ছে মানুষ । বোধ বিবেক বিসর্জন দিয়ে খাদ্যেকে বিষযুক্ত করে জীবনঘাতি করছে। যা করছে তা সব যেনো সত্য সুন্দরের বিরুদ্ধে। অপর দিকে বিবেক বর্জিত মুখোশধারী প্রানির সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে । তীর্থ স্থানগুলোতে তিল ধারণের জায়গার আকাল। যেখানে দায়মুক্তির জন্য ঈশ্বরের সামনে মেকি অভিনয় । যে অভিনয়ের পরে আত্মতৃপ্তিতে সে সমাজের মানুষ তথা পৃথিবীর উপরে আরো নারকীয় জুলুম চালোনোর বৈধ সার্টিফিকেট পায় বলে ধারণা করে। আরো কুতেজী হয়ে চলতে থাকে ; ঈশ্বরের সৃষ্টিকে কলুষিত করতে থাকে । এ ক্ষেত্রে কবি হুমায়ূন আজাদ এর বানী প্রনিধানযোগ্য । তিনি লিখেছেন “ সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে”
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।
পৃথিবী গোটা কতক মানুষের হাতে বন্ধী। মানুষ প্রত্যাশা করে অত্যাচারী ভাগ্যনিয়ন্তক শাসক পরিবর্তন করে নতুন ত্রাতা আসবে । ত্রাতা আসে বিপ্লব ঘটিয়ে কিন্তু ক্ষমতার গদিতে বসলেই হযে যায় বেসামাল , ভুলে য়ায় তার দায়িত্ব কর্তব্য । শুধু তাই নয় পূর্বসূরীর সব রেকর্ড ভেঙে আরো ভয়ংকর শক্তি রূপে আবিভূত হয় । আর আম জনতা যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরে থেকে যায়। তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয় না। তারা নিপেষিত থাকে। তাদের জন্মই যেনো নিপেষনে থাকা। বিশাল শূন্যতা তাদের প্রাপ্তি । আর কত কাল চলবে এভাবে। আমাদের সত্যিকার নেতা প্রয়োজন। যে উদ্ধার করবে পৃথিবী বেশিভাগ বঞ্চিত জনগোষ্ঠির। আমরা মানুষ শাষক চাই। কিন্তু আজ অপদেবতার শাসনে বিশ্ব । কবি সবুজ লিখেছেন:
শুধুই হাত বদল আর দাঁতবদল।/ ক্ষমতার খোয়াড়ে জনতার জীবন।/ উৎপাদকের আমলনামায় শুধু শূন্যের সমুদ্র।’ ( সত্যের সর্বনাশ)
“ লজ্জাবতী নদীর হাসিতে সবুজ পৃথিবীর সর্বনাশ ।/ অন্ধ চোখে সূর্যের বাস।” ( শ্রমিকের বুকে শিশিরের চুমু)
নদী আজ মৃত । নদীর মৃত্যুর জন্য দায়ী মানুষের সর্বগ্রাসী আগ্রাসী মন ।কোনে বাচ -বিচার ছাড়া দখলদালেরা নদী গ্রাস করে পানির প্রবাহ বন্ধ করছে, বাধ দিচ্ছে। পানি দূষিত করছে । মানুষের আমিষের উৎস বন্ধ হচ্ছে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে । ক্ষমতার অন্ধরা আজ বেশি দেখে । তাদেও অধিগ্রহনে সবখান , সমস্ত কিছ্ ু। তাদের সর্বগ্রাসী থাবায় সব আলোর মুখে কালো পর্দার পর কালো পর্দা । অন্ধকারের ভেতরে আরো অন্ধকার করার অবৈধ প্রতিযোগিতা করছে। কিন্তু মুখে আলোর কথা । কবি জীবনান্দ দাস এর কবিতা এক্ষেতে প্রনিধানযোগ্য । তিনি “ অদ্ভুদ আঁধার এক” শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
এ অবস্থা চলতে পারে না । আর কত কাল চলবে । একটি প্রতিবাদী প্রাণ কি নেই! সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে আলো ঝলমলে মানুষের মানবিক পৃথিবী গড়ার ? কিছু প্রতিবাদী মানুষ চাই । যারা এই অশুভ শক্তির ভিত কাঁপায়ে মূলোৎপাটন করতে। শুভ শক্তির প্রয়োজন আজ। এখন একজন বিদ্রোহী প্রয়োজন। কবি আহ্বান করেছেন এক দমকা হাওয়ায়- ভূমিকম্পে নতুন এক পৃথিবী আসুক। কবি সবুজ লিখেছেন “ সত্যের অপমৃত্যু ঘটে সূর্যের সামনেই ।/ মানবিক আদালতে মামলার জট।/ তবুও অবাধ্য বাতাসেরা / লিরিক শোনায় ঝিমধরা সকালের কাছে। ”
অসুন্দরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করারর জন্য বিদ্রোহী প্রয়োজন । যারা নতুন একটি মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলবে । কবির প্রত্যাশা খুব শিঘ্রই পৃথিবী শুভ শক্তির রাজত্ব চলবে । নষ্টরা নিপাতিত হবে নরকে।
কবি “প্রথমার ভালোবাসা” শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন “তবুও প্রেমের প্রদীপ আলো জ্বালায় ”
এত কিছুর পরের মানুষ বেঁচে আছে আশায় এবং প্রেমে । প্রেম-ভালোবাসা না থাকলে মানুষ এই জুলুমে বাঁচতে পারতো না। আসুন আমরা আশাবাদী হয়ে একটি প্রেমময় কাটাতার- বর্ডারহীন মানুষের পৃথিবী গড়ি। আগামি বিশ্বহোক মানুষের ভালোবাসার বিশ্ব।