• শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:০২

হাথুরুসিংহে সাফল্য এনে দিচ্ছেন নাকি ঘোল খাওয়াচ্ছেন?

প্রতিনিধি: / ৩৪ দেখেছেন:
পাবলিশ: বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪

স্পোর্টস: কুমির আর শিয়ালের গল্পটার কথা মনে আছে? বোকা কুমিরকে একই বাচ্চা বারবার দেখিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখত চালাক শিয়াল আর কুমিরও বিপদের একদম শেষ পর্যায় পর্যন্ত চলতে থাকত ভোলাভোলা হয়েই, গলে যেত চালাক শিয়ালের কপটতার কাছে। যখন চরম বিপদটা টের পায় কুমির তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, বের হওয়ার আর কোনো উপায় বাকি নেই। চালাক শিয়ালের সেই চরিত্রে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে কল্পনা করুন। কুমির ভেবে নিন দেশের কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমীদের। সাফল্যের খোঁজে থাকা এক সমর্থকগোষ্ঠীকে কোনো না কোনোভাবে সাফল্য এনে দিলেই তো হলো। ব্যস, আর কী লাগে! দেশের মাটিতে নিজেদের পছন্দমত উইকেট বানিয়ে একের পর এক ম্যাচ জিতে সমর্থকদের আনন্দে ভাসাও, পরিস্থিতি ঠাÐা করে দাও, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দলের বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাক, তাতে কার কী এসে যাচ্ছে? লোকদেখানো কিছু সাফল্য তো মিলেছে দেশের মাটিতে। বিশ্বজয়ের অর্ধেক বুঝি হয়ে গেছে এখানেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটের চিত্রটা বর্তমানে অনেকটা এমনই। ঘরের মাঠে বাড়তি সুবিধা নেওয়াটা কোনো অপরাধ নয়। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই তা করে থাকে। তবে বেশিরভাগ দেশের কাছে পর্যাপ্ত সম্পদও থাকে যার ফলে দেশের বাইরে অচেনা উইকেটেও কিছু সাফল্য অন্তত মেলে, ঘরের মাঠে কাড়ি কাড়ি সাফল্য না মিললেও। ঠিক এখানেই যেন ঢের পিছিয়ে বাংলাদেশ দল। ঘরের মাঠে ¯েøা, লো, টার্নিং উইকেটে সফল হওয়ার জন্য দক্ষ স্পিনার দলে থাকলেও বিদেশের স্পোর্টিং বা ট্রু উইকেটে সফল হওয়ার মত বোলার দলে আছেন খুবই কম। আর ধীরগতির উইকেটে খেলে অভ্যস্ত ব্যাটাররা স্পোর্টিং উইকেটে রান করতে গিয়ে করেন হাঁসফাঁস। বিশ্বমঞ্চে তাই বড় রানের দেখা পাওয়াটা এভারেস্ট ডিঙানোর মতই কঠিন হয়ে যায় বাংলাদেশের ব্যাটারদের জন্য। ব্যাটে নেই রান, বোলাররা নিতে পারছেন না উইকেট; ম্যাচ আপনি জিতবেন কেমন করে? হাথুরুসিংহের প্রথম অধ্যায়ে এসব ব্যাপার হরহামেশাই ঘটেছে। দ্বিতীয় অধ্যায়েও ঘটছে। ঘরের মাঠের স্পিন উইকেটে ইংল্যান্ড, আফগানিস্তানকে সিরিজ হারিয়ে দিলেও বিশ্বমঞ্চে নেপাল, নেদারল্যান্ডসের সাথে জিততেও ঘাম ছুটে যাচ্ছে বাংলাদেশের। আফগানিস্তান তো চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছে পার্থক্যটা। তাহলে ঘরের মাঠের সাফল্যগুলো কি আদতে সাফল্য ছিল নাকি দর্শকদের ঘোল খাইয়ে পরিস্থিতি ঠাÐা রাখার চেষ্টা? উত্তর খোঁজাটা অত কঠিন কিছু বলে মনে হয় না। দ্বিতীয় মেয়াদে হাথুরুসিংহেকে বহু কাঠখড় পুড়িয়েই ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এতকিছুর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল হাথুরুর কোচিংয়ের ধরনে বিসিবির অগাধ আস্থা। তবে প্রত্যাশাও ছিল বিশাল – আইসিসির ইভেন্টে বড় মঞ্চে বাংলাদেশকে বড় সাফল্য এনে দেওয়া। হাথুরুর অধীনে দুইটি বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা কাগজে-কলমে দেশের ইতিহাসের সেরা বটে। তবে মাঠের দলের পারফরম্যান্স অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ক্রিকেটারদের শরীরিভাষা, মাঠে নামার আগেই হারের শঙ্কা পেয়ে বসার মত বাজে ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি সুপার এইটের শেষ ম্যাচে যেখানে কিছু সমীকরণ মেলাতে পারলে সেমিফাইনালের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছিল সেখানে দলের প্রাথমিক লক্ষ্য নাকি ছিল শুধু ম্যাচ জেতা! বিশ্বকাপের সুপার এইটে খেলার লক্ষ্য নিয়ে দেশ ছাড়া দল সুপার এইটে গিয়ে খেলেছে ছন্নছাড়া ক্রিকেট। প্রধান কোচ হাথুরুও সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সুপার এইটের পর যা পাওয়া যাবে সবই বোনাস, মূল লক্ষ্য তো অর্জন হয়েই গেছে। জেতার ক্ষুধাটা কি আদৌ ছিল দলের মাঝে? প্রশ্ন উঠাটাই স্বাভাবিক। ভারতে আয়োজিত ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের দেশের ইতিহাসের অন্যতম বাজে টুর্নামেন্ট হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৯ ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে কেবল ২ ম্যাচে। হারতে হয়েছে বাছাইপর্ব পার করে আসা নেদারল্যান্ডসের কাছেও। হারা ম্যাচগুলোতে গড়তে পারেনি নূন্যতম প্রতিরোধও। নিজেদের পছন্দের ফরম্যাট ওয়ানডেতে কি এতটা দুর্বল দল ছিল বাংলাদেশ? ওয়ানডে সুপার লিগে তৃতীয় হয়ে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করা বাংলাদেশ কেন এতটা ভেঙে পড়ল আসল জায়গায় গিয়ে? গলদটা কোথায়?
ভারত বিশ্বকাপের আগে মাঠের বাইরের নানা ব্যাপারে উত্তপ্ত ছিল দেশের ক্রিকেট। যার প্রভাব মাঠের ক্রিকেটে কিছুটা হলেও পড়েছে বলে আঁচ করা যায়। সেই সাথে বিশ্বকাপের মত জায়গায় ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে স্মরণকালের সর্বোচ্চ পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছে বাংলাদেশ। মেহেদী হাসান মিরাজকে গিনিপিগ বানিয়ে একেক দিন খেলিয়েছে একেক পজিশনে। এসব কিছু কতটা কাজে লেগেছে সেই প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হবে দলের পারফরম্যান্সে নজর রাখলেই। ১০ দলের মধ্যে ৮ম হয়ে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ দল, ২০১৯ বিশ্বকাপেও হয়েছিল ৮ম। হাথুরুর অধীনে বড় সাফল্য বলতে গেলে ইংল্যান্ডকে ৩-০ ব্যবধানে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করা, আফগানিস্তানকে ২-০ ব্যবধানে একই ফরম্যাটে হোয়াইটওয়াশ করার কথা আসবে সবার আগে। এ ছাড়া নিউজিল্যান্ডের কঠিন কন্ডিশনে একটি করে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জেতাও অবশ্যই দারুণ ব্যাপার। কিন্তু ইংল্যান্ড-আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়গুলো এসেছে দেশের মাটিতে। এই সাফল্য আদতে কতটা সাফল্য ছিল বড় মঞ্চে ভরাডুবির পর সেই প্রশ্নটা তাই এখন উঠতে বাধ্য। বড় ব্যর্থতার কথাও বিবেচনায় নিতে হবে। দুই-দুইটি বিশ্বকাপে দলের হতশ্রী চিত্র বড্ড চোখে লেগেছে। সেই সাথে ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার সাথে টেস্ট সিরিজে ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। জিম্বাবুয়ের কাছে সিরিজের এক ম্যাচে হার, বিশ্বকাপের ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হার এসেছে হাথুরুর অধীনেই। হারা-জিতার চেয়েও বেশি আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের খেলার অ্যাপ্রোচ, ব্যাটারদের ইনটেন্ট, ক্রিকেটারদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। কোথায় যেন একটা গা বাঁচিয়ে খেলার ইচ্ছা, হারের আগেই হার মেনে নেওয়া – সবকিছুই ছিল দৃষ্টিকটু। আর জেতার জন্য তীব্র ক্ষুধা-আকাক্সক্ষা? এসব তো দূর কী বাত। বাংলাদেশ চাইলে বরং আফগানিস্তানের কাছ থেকে শিখতে পারে কীভাবে অসম্ভবে বিশ্বাস রেখে তা বাস্তবে নামিয়ে আনা যায়। কেউ সেমির হিসাবে তাদের না রাখলেও দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে এখন খেলবে তারাই। করতে পারি বা না পারি আশা তো থাকতেই পারে যেকোনো কাজে, হোক না তা চরম অসম্ভব কিছু – আফগানিস্তান এমন মন্ত্রে বলীয়ান হলেও বাংলাদেশ যা পেয়েছে তা নিয়েই খুশি। অবশ্য সুপার এইটে উঠেই যদি কোনো দল ভেবে নেয় যা অর্জন করার তা হয়ে গেছে, এখন যা আসবে সব বোনাস, তাহলে সে দলের সেমিফাইনালে না খেলাই ভালো, অন্তত ক্রিকেটের সৌন্দর্যের স্বার্থে।

 


এই বিভাগের আরো খবর
https://www.kaabait.com