এসএম শামীম
রাজধানী শাহবাগ মোড়ে রোববার (২৬ জানুয়ারি) স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের ওপর পুলিশি
লাঠিচার্জ এবং জলকামান, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের ঘটনা গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে।
মাদ্রাসা শিক্ষকদের উপর এই ধরনের সহিংসতার ঘটনায় তাদের মৌলিক অধিকার এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় সুষ্ঠু
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। এই ধরনের ঘটনায় যে প্রশ্নগুলি উঠে আসে, তা শুধু
পুলিশের দমনমূলক আচরণ সম্পর্কেই নয়, বরং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা উন্মোচিত করে,
যার সমাধান ছাড়া সুষ্ঠু সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে কম বেতনে কাজ করছেন এবং তাদের দাবিগুলো একেবারেই ন্যায্য।
তারা জাতীয়করণের মাধ্যমে তাদের পেশাগত মর্যাদা এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন। একদিকে
সরকারের কাছ থেকে ন্যায্য দাবি পূরণের আশায় তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, অন্যদিকে পুলিশের এমন
অমানবিক আচরণ কেবল তাদের আন্দোলনকে দমন করছে না, বরং বৃহত্তর জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি
আস্থা এবং শ্রদ্ধাও ক্ষুন্ন করছে।
ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবিটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। দেশে বহু বছরের পুরনো একটি সমস্যা এটি।
এসব মাদ্রাসার শিক্ষকরা অনেকাংশেই সীমিত বেতন ও অসহনীয় কাজের পরিবেশের মধ্য দিয়ে কাজ করছেন।
তাদের কাজের পরিধি এবং শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ব্যাপক, কিন্তু আর্থিক সুবিধা খুবই কম। বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য, শিক্ষকদের স্বীকৃতি না পাওয়া এবং জাতীয়করণ না হওয়া তাদের পেশাগত মর্যাদাকে সংকুচিত
করেছে। এর মধ্যে, পেনশন, চিকিৎসা সুবিধা, এবং বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের অভাব আরও
কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
তাদের শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখানোর পরেও পুলিশি লাঠিচার্জের ঘটনা
সত্যিই অবিশ্বাস্য। এটি শুধু শিক্ষা খাতে সহিংসতার প্রতিফলন নয়, বরং পুলিশের দায়িত্বহীনতা ও একতরফা
দমনমূলক শক্তি প্রয়োগের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। কেননা, একজন শিক্ষক বা কর্মী তার ন্যায্য অধিকার
দাবি করলে তাকে সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি প্রয়োগের মুখোমুখি করা অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য। এই ধরনের আচরণ
মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি অসম্মান।
এ ঘটনার মাধ্যমে সরকারের ওপর একাধিক প্রশ্ন উঠছে। প্রথমত, সরকার কি মাদ্রাসা শিক্ষক ও
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সুরক্ষিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? দ্বিতীয়ত, কেন পুলিশ তাদের
শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে দমন করতে গিয়ে সহিংসতা প্রয়োগ করেছে? সরকার যদি শান্তিপূর্ণ
আন্দোলনকারীদের সাথে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান না করে, তবে এটি রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের
বিশ্বাসকে কমিয়ে দেয় এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
শিক্ষা, বিশেষত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষাগত অগ্রগতির জন্য
অপরিহার্য। এর একটি বড় অংশ হলো শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। সেক্ষেত্রে, তাদের দাবির প্রতি সরকার
যদি অগ্রাহ্য থাকে, তবে এই ধরনের সহিংসতাই ঘনীভূত হবে, যা দেশের সমাজে একটি বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে, অবিলম্বে মাদ্রাসা শিক্ষকসমাজের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে
আলোচনায় বসা। শিক্ষকরা দেশের অমূল্য রত্ন এবং তাদের প্রতি ন্যায্যতা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা
সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে পুলিশের সহিংসতা বন্ধ করে, সরকারকে শিক্ষা সংস্কারের একটি সুষ্ঠু
রূপরেখা তৈরি করতে হবে।
পরিশেষে, মাদ্রাসা শিক্ষকরা একসময় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র ছিলেন এবং এখনো তারা
জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাদের ন্যায্য দাবির প্রতি সরকারকে সহানুভূতিশীল হতে হবে, এবং
সেইসাথে পুলিশের বর্বরতার বিরুদ্ধে তদন্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষকদের আন্দোলন এক সময়
হয়তো সফল হবে, তবে তার জন্য সরকারের সঠিক পদক্ষেপ প্রয়োজন, যাতে এই আন্দোলন সহিংসতার শিকার
না হয় এবং তা সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হয়ে ওঠে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
https://www.kaabait.com