• শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:৪৩

থাইল্যান্ড সফর দ্বিপাক্ষিক সর্ম্পক উন্নয়নে এক মাইলফলক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রতিনিধি: / ৪৪ দেখেছেন:
পাবলিশ: বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০২৪

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাইল্যান্ডে ২৪ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি সফর শেষে বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে তিনি একটি লিখিত ভাষণ পড়ে শোনান। সেখানে তিনি থাইল্যান্ড সফরকে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সর্ম্পক উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ:
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিন এর আমন্ত্রণে দ্বিপাক্ষিক সফরে এবং ইউএন-এসক্যাপ এর ৮০তম অধিবেশনে যোগদানের জন্য আমি গত ২৪ থেকে ২৯ এপ্রিল ২০২৪ থাইল্যান্ড সফর করি। কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ আমার সফরসঙ্গী ছিলেন।
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ব্যাংককে পৌঁছালে বিমানবন্দরে আমাকে লালগালিচা সংবর্ধনা, গার্ড অব অনার ও গান স্যালুটের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
গত ২২ হতে ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ব্যাংককে ইউএন-এসক্যাপ এর ৮০তম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদানের জন্য সংস্থাটির এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দেশে ব্যস্ত থাকায় আমি তাতে অংশ নিতে পারিনি। তবে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অধিবেশনের মূল প্রতিপাদ্য ‘এশীয়-প্রশান্ত মহাসারীয় অঞ্চলে টেকসই উন্নয়নে ডিজিটাল উদ্ভাবনা জোরদার’ বিষয়ে আমার পূর্বধারণকৃত একটি ভিডিও বার্তা প্রদর্শন করা হয়।
২৫ এপ্রিল সকালে ইউএন-এসক্যাপের এর একটি অধিবেশনে আমি এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলে সহযোগিতা জোরদার করার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের এজেন্ডা ২০৩০ ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করি। আমি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অভিজ্ঞতা তুলে ধরার পাশাপাশি ইউএন-এসক্যাপ এর মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত ও বাস্তবায়িত বিভিন্ন উন্নয়ন মডেল এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বিনিময় করার বিষয়ে আমাদের আগ্রহ ব্যক্ত করি।
আমি সকল ধরনের আগ্রাসন ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য এবং যুদ্ধকে ‘না’ বলার জন্য আবারও আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের প্রতি আহŸান জানাই।
আমি ফিলিস্তিনে অব্যাহত গণহত্যা; মিয়ানমারে চলমান সংঘাত, ও রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলসহ বিশ্ব স¤প্রদায়কে একযোগে কাজ করার আহŸান জানাই।
একইদিন, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ইউএন-এসক্যাপ এর এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি মিজ্ আরমিদা সালসিয়ান আলিসজাহবানা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আলাপকালে, আমি দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করি।
ইউএন-এসক্যাপ এর ৮০তম বার্ষিক অধিবেশনের বিভিন্ন সেশনে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বক্তব্য প্রদান করেন।
সম্মেলনস্থলে আইসিটি বিভাগের আয়োজনে একটি সাইড ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয় এবং ‘ডিজিটাল টু স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ শীর্ষক প্যাভিলিয়ন স্থাপন করা হয়। আমি প্যাভিলিয়নটি ঘুরে দেখি।
একইদিন বিকেলে আমি থাইল্যান্ডের রাজপ্রাসাদে মহামহিম রাজা মহা ভাজিরালংর্কন ফ্রা ভাজিরা ক্লাওচা উহুয়া এবং মহামহিমা রাণী সুধিদা বজ্রসুধা বিমলা লক্ষণ-এর সঙ্গে দেখা করি।
এ সময় আমি থাইল্যান্ডের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের জন্য রাজা ও রাণীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই এবং দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে একসাথে কাজ করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করি।
সফরের তৃতীয় দিন ২৬ এপ্রিল গভর্নমেন্ট হাউজে পৌঁছিলে আমাকে রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনারের মাধ্যমে থাই প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় থাইল্যান্ডে স্বাগত জানান।
পরে গভর্নমেন্ট হাউসে আমি থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিন এর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে অংশগ্রহণ করি। বৈঠকে অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের পাশাপাশি আমি জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত মায়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর) দ্রæত তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের জন্য থাইল্যান্ডের সহায়তা কামনা করি।
একান্ত বৈঠকে শেষে আমার এবং থাইল্যান্ডের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দু’দেশের প্রতিনিধিদলের অংশগ্রহণে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দীর্ঘস্থায়ী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অধিকতর উন্নয়নকল্পে আমরা গঠনমূলক আলোচনা করি। এ সময় আমি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞান-ভিত্তিক, ডিজিটালাইজড এবং জলবায়ু সহনশীল দেশে রূপান্তর এবং বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মূল্যবান অংশীদার হিসেবে থাইল্যান্ডের সহযোগিতা কামনা করি।
বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য স¤প্রসারণ এবং আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’-এর পর্যালোচনার পাশাপাশি অন্যান্য অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল বিনিয়োগ, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক বিনিময়, পর্যটন সহযোগিতা, জালানি নিরাপত্তা, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, স্থল এবং সমুদ্র সংযোগ, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
এ সময় আমি দুই দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষার জন্য বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকে বিশেষ করে, আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য থাই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করি।
থাই প্রধানমন্ত্রীকে তৈরি পোষাকসহ কিছু বাংলাদেশী পণ্যের একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছি।
কৃষি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে কৃষিখাতে পারস্পরিক সহযোগতিা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে পারি। এজন্য থাইল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের সহযোগতিা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করেছি।
আমরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে আলোচনা করি। থাইল্যা-কে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগেরও আহŸান জানাই।
নিরবচ্ছিন্ন আঞ্চলিক যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে থাইল্যান্ডের রানং বন্দর এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে সরাসরি কোস্টাল শিপিং দ্রæত চালু করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে আমরা একমত পোষণ করি। এ ছাড়াও, আঞ্চলিক সহযোগিতা সুদৃঢ়করণে ‘ভারত-মিয়ারমার-থাইল্যান্ড’ তে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়ে আমাদের প্রত্যাশা পুনর্ব্যক্ত করি।
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড উভয়ই বিমসটেকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আমি ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী একমত পোষণ করি যে, বিমসটেক এ অঞ্চলের প্রায় ১৮০ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হতে পারে। আমি থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে বিমসটেকের বর্তমান সভাপতি হিসেবে অভিনন্দন জানাই এবং তাঁর নেতৃত্বে থাইল্যান্ড শীঘ্রই বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে সফলভাবে আয়োজন করবে মর্মে শুভকামনা জানাই।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ আসিয়ানের প্রতিবেশী। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশের আসিয়ানের ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ মর্যাদা চলতি বছরের মধ্যে প্রাপ্তির জন্য আবেদনের বিষয়ে থ্যাইল্যান্ড সরকারের নিকট আবারও অনুরোধ জানিয়েছি।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে, দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি চুক্তি, তিনটি সমঝোতা স্মারক ও একটি ‘আগ্রহ পত্র’ লেটার অব ইনটেনশন) সই হয়েছে। সেগুলো হলো:
(ক) অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি সংক্রান্ত চুক্তি;
(খ) জ্বালানি সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক;
(গ) পর্যটন সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক;
(ঘ) শুল্ক সংক্রান্ত পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক; এবং
(ঙ) মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরু করার জন্য একটি আগ্রহ পত্র
চুক্তি ও সমঝোতাসমূহ স্বাক্ষর শেষে আমি ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিনেরন সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখি। সংবাদ সম্মেলন শেষে আমার সৌজন্যে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক আয়োজিত রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজে যোগদান করি। আমার ছোট বোন শেখ রেহানাও এতে অংশ নেয়।
থাইল্যান্ডে আমার সরকারি সফরটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটি আমাদের দুই দেশের মধ্যে ফলপ্রসু অংশীদারিত্বের একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে।
আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের সরকারি সফর অত্যন্ত তাৎর্পযর্পূণ। সফরে দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরুর বিষয়ে অগ্রগতি, আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি প্রভৃতি দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে বিশেষ গুরুত্ব পালন করবে। ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের আসিয়ানের ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’-এর প্রার্থীতা লাভের জন্য এ সফর উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে থাইল্যান্ডের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনা থাইল্যান্ডকে দ্বিপাক্ষিকভাবে এবং আঞ্চলিক জোট আসিয়ানে রোহিঙ্গাদের দ্রæত প্রত্যাবাসনে জোরালো অবস্থান নেওয়ায় সহায়তা করবে মর্মে আমি আশাবাদী।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষা এবং আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের বিশেষ প্রয়াস হিসেবে এ সফরটি সফল ও ফলপ্রসূ হয়েছে বলে আমি মনে করি।


এই বিভাগের আরো খবর
https://www.kaabait.com