ফরহাদ মাহমুদ
পৃথিবীতে হিব্রæ সভ্যতার ইতিহাস আজ অজানা নয়। যদিও হিব্রæ একটি ভাষার নাম; কিন্তু কালক্রমে এটি একটি জাতির পরিচায়ক এমনকি একটি ধর্মের নামেও পরিচিত হয়। পৃথিবীতে আধুনিক যুগে আজকে যে ইহুদিদের পরিচয় পাই তাদেরই আগের নাম হিব্রæ। সে অনেক আগের কথাÑ ইব্রাহিম নামে এক নবীর মাধ্যমে এ ধর্মের বিকাশ সাধন হয়। পরে ইব্রাহিমের পুত্রের ঘরে আরেক নবীর আগমন ঘটে তার নাম ইয়াকুব। যার অপর নাম ইসরাইল। পরে ইসরাইলের বংশের লোকদের বনি ইসরাইল নামে ডাকা হতো। পবিত্র কোরআনুল কারিমে বনি ইসরাইল হিসেবে অনেকাংশেই নাম ব্যবহার করা হয়েছে। হজরত মুসার (আ.) আগে ইয়াকুবের (আ.) সময় আরবে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণে ইয়াকুব তার গোত্রের লোকদেরসহ মিসরে বসবাস করতে থাকেন। ইয়াকুবের এক পুত্রের নাম ছিল ইউসুফ। যিনি মিসরের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় মূলত হিব্রæ জাতির লোকেরা মিসরে রাজকীয় সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে; কিন্তু কালক্রমে কিতবি জাতি, যারা মিসরে স্থায়ী বাসিন্দা ছিল তাদের হাতে শাসন কাঠামো চলে যায়। কিতবি জাতির শাসকদের উপাধি ছিল ফেরাউন। এ ফেরাউন রাজারা বিরাট প্রতিপত্তি অর্জন করে। তারা বনি ইসরাইলদের দাস হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে এবং ইসরাইল জাতির ওপর অন্যায় অত্যাচার চালাতে থাকে। এ সময় নবী মুসার আগমন ঘটে। যিনি ফেরাউনের সঙ্গে দ্বন্দে¡ লিপ্ত হয়ে ঈশক শক্তির মাধ্যমে ফেরাউনকে পদানত করে এবং বনি ইসরাইলদেরকে দাসত্বের হাত থেকে উদ্ধার করেন। এ সময় থেকেই ইসরাইল জাতির নব উত্থান ঘটে। তারা তখন থেকে ইহুদি নামে পরিচিত হয়ে আজ অবধি সে নামেই বিশ্বব্যাপী বিশেষ স্থান দখল করে আছে। পৃথিবীতে বহুকাল আগের সে হিব্রæ ভাষা আজো হিব্রæ জাতির যোগ্য উত্তরসূরি ইহুদিদের মধ্যে টিকে আছে। হিব্রæ জাতির সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইহুদি জাতি আল্লাহর একাÍবাদে বিশ্বাসী ছিল। এ কারণে ইহুদি ধর্ম একেশ্বর বাদী ধর্ম। এ ধর্মে ব্যক্তি জীবনের সব দিকও বিভাগ থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্রে, সর্বস্থানেই একাÍবাদের ধারণা প্রতিষ্ঠিত। ধর্মীয় একাÍবাদে বিশ্বাস ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধনে এ ধর্মে নিজেকে আল্লাহর বান্দা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রচেষ্টা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ এ ধর্মে বিশ্বাসী সবাইকে মনে করতে হবে যে, সে আল্লাহর বান্দা এবং তার উদ্দেশ্য থাকবে জীবনে সব কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। ইহুদিদের ধর্ম অহিভিত্তিক ঐশী গ্রন্থের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। ইসলাম ধর্মের মতে এ জন্য ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মকে বলে আহলে কিতাব অর্থাৎ কিতাবের অনুসারী। এ কিতাব বলতে ইহুদি ধর্মের তাওরাতকে বুঝানো হয়েছে, যা হজরত মুসার (আ.) ওপর নাযিল। তুর পর্বতে ৪০ দিন ধ্যানমগ্ন হওয়ার পর তার ওপর আসমানি ওহি হিসেবে তাওরাত অবতীর্ণ হয়। একাÍবাদের দাওয়াতই ছিল তাওরাতের মূলমন্ত্র। যা আজো ইহুদি ধর্মে পালনীয়। এ সম্পর্কে তাওরাতে উল্লেখ আছে ‘আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তার কোনো শরিক নেই। তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আরো উল্লেখ আছে- আল্লাহর অস্তিত্ব বা অবস্থান আছে, তবে তিনি অশরীরী ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর ঊর্ধ্বে। তিনি নিরাকার। ইহুদি ধর্মে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা দেয়া আছে। ইসলামে যাকে বলে ইখতিয়ার। যার অর্থ হলো মানুষের কর্মকাÐের স্বাধীনতা। ইচ্ছা করলে সে ভালো কাজ করতে পারবে ইচ্ছা করলে মন্দ কাজও করতে পারবে। এ ব্যাপারে তাওরাতের বক্তব্য হলো- আল্লাহ সব কার্যাবলি সম্পর্কে অবগত। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। আল্লাহ প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে পু´খানুপু´খ জ্ঞাত।’ ইহুদি ধর্মের মৌলিক নীতিমালাগুলোর মধ্যে রয়েছে আখেরাতের ওপর বিশ্বাস। অর্থাৎ মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করার তাগিদ এ ধর্মে রয়েছে। এভাবে নবী ও রাসুল গণের আগমনকে সত্য বিবেচনা করা ইহুদি ধর্মের একটি মূল বিশ্বাস। এ ব্যাপারে তাওরাতে উল্লেখ আছে, অর্থাৎ প্রেরিত মহাপুরুষ তথা নবীও রাসুলগণ সত্য। তাদের প্রচারিত বাণী সত্য ও পালনীয়। সুদ প্রথাকে ইহুদি ধর্মে হারাম বিবেচনা করা হয়। অনুরূপভাবে এ ধর্মে শ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে বিবেচনা করা হয় হজরত মুসাকে (আ.)। তাদের মতে বনি ইসরাইলরাই আল্লাহর কাছে প্রিয় বান্দা এবং মুসা (আ.) শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল। পরিশেষে বলা যায় যদিও ইহুদি ধর্ম আজ মৌলিক ধর্মীয় প্রথা থেকে কিছুটা হলেও বিচ্যুত হয়েছে; তদুপরী বিশ্বব্যাপী ইহুদি ধর্মের পরিচয় পরিচিতি ও প্রভাব প্রতিপত্তির কমতি নেই। ইহুদিদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বিভিন্ন দিক ও বিভাগ ঐক্যতা ও সামঞ্জস্যতা রয়েছে। এ দুই ধর্মের মৌলিক বিষয়ে ঐক্য থাকার আহলী কিতাব হিসেবে ইসলাম ধর্মে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের গ্রহণ যোগ্যতা পৃথিবীর অন্য ধর্মের চেয়ে বেশি। সেমেটিক ধর্মের মধ্যে এ তিনটি ধর্মের মিল ও ঐক্যতার কারণে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও হৃদ্যতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলা সহজ। কারণ সব ধর্মের কাজ শান্তি কায়েম ও স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা। এ জন্য সব ধর্মের ঐক্য গড়ে তোলা আজকের সময়ের দাবি।
ছবি-০৪
শিখ ধর্মাবলম্বীদের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে ধারণা
মাসুদা জাহান রাখি
পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যায়, প্রধান প্রধান ধর্মগুলো সাধারণত দুভাগে বিভক্ত। প্রথমটি সেমেটিক ধর্ম আর দ্বিতীয়টি হলো নন-সেমেটিক ধর্ম। সেমেটিক ধর্ম সাধারণত সিমায়েটরা অনুসরণ করে। এ শাখার প্রধান প্রধান ধর্ম হলোÑ ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম। এ তিনটি প্রধান ধর্মই অহিভিত্তিক ও নবীভিত্তিক ধর্ম। আর নন-সেমেটিক ধর্ম হলো, যারা সেমেটিক ধর্ম নয়। সেমেটিক বাদে বাকি সব ধর্মই নন-সেমেটিক। নন-সেমেটিক ধর্মগুলোকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাÑ আরিয়ান এবং নন-আরিয়ান। সাধারণভাবে বলা যায়, উত্তর ভারত ও ইরানে ইন্দো-ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের যেসব লোক বাস করে তারা আরিয়ান ধর্মের লোক। নন-আরিয়ান বলতে গণচীনের ধর্মগুলোকে বোঝায়। সেখানকার বড় বড় ধর্মগুলো যেমনÑ তাইজম, কনফুসিয়াসিজম, সিনটেরিজম ইত্যাদি।
আরিয়ান ধর্ম আবার দুই ভাগে বিভক্ত যথাÑ বেদিক ধর্ম ও নন-বেদিক ধর্ম। বেদিক বলে সাধারণত খ্রিস্টপূর্ব দেড় থেকে দুই হাজার বছর আগের বৈদিক যুগের ধর্মকে বোঝায়। এ দ্বারা আর্র্য জাতির আমলে বৈদিক ও মহাকাব্যের পরবর্তী ব্রাø ধর্মকে বোঝায়। এ ব্রাø ধর্ম মূলত সনাতন হিন্দু ধর্মেরই পূর্ব নাম এবং আর্য জাতির ভারতের স্থায়ী বাসিন্দারাই পরবর্তী যুগে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে পরিচিত। নন-বেদিক ধর্ম বলতে বেদ-পরবর্তী অহিন্দু ধর্মগুলোকে বোঝায়। সেখানে যেমনÑ জৈনধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও শিখ ধর্ম ইত্যাদি। আজকে আমরা নন-সেমেটিক আরিয়ান নন-বেদিক ধর্ম থেকে শিখ ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আমরা জানি, শিখ শব্দটি এসেছে ‘শিসিয়া’ শব্দ থেকে। শিখ শব্দের অর্থ হলোÑ অনুসরণকারী, অনুকরণকারী। এ ধর্মটি নন-সেমেটিক আরিয়ান নন-বেদিক বড় ধর্মগুলোর মধ্যে সর্বকনিষ্ট ধর্ম। পঞ্চদশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া এ ধর্মটি ভারত উপমহাদেশে বেশ পরিচিত। অন্যান্য আরিয়ান ধর্মের তুলনায় অনুসারী কিছুটা কর্ম হলেও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে তারা সদাসর্বদাই তৎপর।
শিখ ধর্মের প্রবর্তক হলেন গুরু নানক শাহী। যিনি পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তার এ ধর্ম মূলত উৎপত্তি হয় পাকিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের কাছে পাঞ্জাব রাজ্যে। ভারতের অমৃতসরে এ ধর্মের প্রধান তীর্থস্থান গুর নানক শাহের এ ধর্মে রয়েছেন দশজন গুরু। শেষ গুরুর নাম হলো গুরু গোবিন্দ সাহেব। গুরু নানক শাহীর জন্ম ইয়েছিল ত্রেয় বংশে। ত্রের হিন্দু ব্রাহ্মণ্য জাত-শ্রেণীর দ্বিতীয় স্তর। গুরু নানক জাতিপ্রথার এ বৈষম্য সহ্য করতে পারেননি। তিনি যে নতুন শিখ ধর্মের ভিত্তি রচনা করেন তা কিন্তু আসলে হিন্দু ধর্মেরই একটি শাখা। হিন্দু ধর্মের শাখা হলেও শিখ ধর্মে মুসলমানদের প্রভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। শিখ ধর্মের মহাপবিত্র গ্রন্থের নাম শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহেব। শিখ ধর্মের মর্মবাণী তাদের পবিত্র গ্রন্থ গ্রন্থ সাহেবে সংরক্ষিত আছে। ইসলাম ধর্মসহ অহিভিত্তিক ধর্মের মতো আরিয়ান ধর্মের কোনটিরই আসমানি কিতাব নেই। অথবা নেই তাদের কোনো সহিফা বা কিতাবপ্রাপ্ত নবীওÑ যা ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মে আছে। আরিয়ান ধর্মের প্রায় সব ধর্মের ধর্মগ্রন্থই মানব রচিত এবং কোনো না কোনোভাবে কাহিনী ও উপদেশনির্ভর। এদিক থেকে শুধু ভাগবতগীতা ও আবেস্তার বক্তব্য কিছুটা অসাধারণ। শিখ ধর্মের গুরু গ্রন্থ সাহেবও মানব রচিত উপদেশ এবং দর্শননির্ভর ধর্মবাণী। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে শ্রী গুরুর গ্রন্থ সাহেবের একেবারে শুরুতেই বলা আছেÑ ‘সৃষ্টিকর্তা সকল প্রকার ভয় ও ঘৃণা থেকে মুক্ত। যিনি অমর, শয়ম্বু। তিনি নিজেই জন্মেছেন। তিনি মহান ও করুণাময়।’ তারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। এমনকি একেশ্বরে বিশ্বাসী। তারা অবতারবাদে বিশ্বাসী নয় এবং মূর্তি পূজাও তাদের ধর্মে নেই। ঈশ্বরকে তারা ডাকে ওংকারানামে। প্রত্যেক শিখকে পাঁচটি বিষয় পালন করতে হয়, তাহলোÑ কেশ না কেটে লম্বা করে ফেলা; দ্বিতীয়ত, কাঙ্গা বা চিরুনি ব্যবহার করা; তৃতীয়ত, আÍশক্তি ও আÍসংযমের জন্য কড়া বা লোহার চুড়ি ব্যবহার করা; চতুর্থত, আÍরক্ষার জন্য কৃপাণ বা ছুড়ি সংরক্ষণ করা এবং পঞ্চম হচ্ছে, কাস্তা বা হাঁটু অবধি লম্বা অন্তর্বাস এবং মাথায় পাগড়ি পরিধান করা। শিখ ধর্মের প্রার্থনা কেন্দ্রকে বলা হয় ‘গুরু দুয়ারা’। সর্বোপরি বলা যায়, সংখ্যায় কম হলেওন শিখ ধর্ম মেধা ও প্রজ্ঞাবান একটি জাতি। সুশৃ´খল ও সামাজিক শান্তি বিনির্মাণে এ ধর্মের ভ‚মিকা গুরুত্বপূর্ণ।
https://www.kaabait.com