বিদেশ : ব্রিটেনের কারাগার থেকে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির খবরকে স্বাগত জানিয়েছে বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। তবে মার্কিন এই মামলাটি সাংবাদিকতার জন্য একটি খারাপ নজির স্থাপন করেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার আইনজীবীরা। তারা আশঙ্কা করছেন, এই ঘটনাটি তথ্য ফাঁসকারীদের কাছ থেকে সাংবাদিকরা গোপন তথ্য গ্রহণ করলে গুপ্তচরবৃত্তি আইনের অধীনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পথ খুলে দিয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই খবর জানিয়েছে। মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি আইন লঙ্ঘনের একটি অভিযোগে গতকাল বুধবার অ্যাসাঞ্জকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ১৪ বছরের আইনি জটিলতা শেষে আদালতে দোষ স্বীকার করে একটি সমঝোতা চুক্তিতে আসায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ওই চুক্তিতে অ্যাসাঞ্জকে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়। ২০১০ ও ২০১১ সালে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ গোপন সামরিক-ক‚টনৈতিক নথি ফাঁস করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাসাঞ্জ। মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক গোয়েন্দা বিশ্লেষক চেলসি ম্যানিংয়ের সহায়তায় এই কাজ করেন তিনি। এ ঘটনায় ২০১৯ সালে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ১৮টি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল মার্কিন কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সাল থেকে পাঁচ বছর ধরে লন্ডনের বেলমার্শ কারাগারে বন্দি ছিলেন অ্যাসাঞ্জ। সেখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এর আগে গ্রেপ্তার এড়াতে লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে দীর্ঘদিন অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। বেশ কয়েকটি অধিকার গোষ্ঠী, নেতৃস্থানীয় মিডিয়া সংস্থা এবং অস্ট্রেলিয়াসহ মেক্সিকো ও ব্রাজিলের নেতারা অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের আহŸান জানিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে অ্যাসাঞ্জের প্রচারাভিযান দলের একজন আইনজীবী ছিলেন তার স্ত্রী স্টেলা। তিনি বলেছিলেন, স্বামীর মুক্তির সংবাদে উচ্ছ¡সিত হয়েছিলেন তিনি। তবে মুক্তির লাভের জন্য অ্যাসাঞ্জের একটি চুক্তিতে সম্মত হওয়া এখনও সাংবাদিকদের জন্য, বিশেষ করে যারা জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। সেই উদ্বেগেরই প্রতিফলন হয়েছে উইকিলিকসের প্রধান সম্পাদক ক্রিস্টিন হাফনসনের কথায়। তিনি বলেন, ‘আমি মোটামুটি নিশ্চিত, সাংবাদিকরা ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত এমন জাতীয় নিরাপত্তার সমস্যাগুলো নিয়ে প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে দ্বিধাবোধ করছেন। কেননা, অ্যাসাঞ্জের ঘটনাটি ইতোমধ্যে এমন সংকেত দিচ্ছে-‘আমাদের থেকে দূরে থাকুন। জনস্বার্থে কিছু করা হচ্ছে কি না তা আমরা বিবেচনায় নেব না। আমরা আপনার পিছু নেব।’ যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সাবেক সম্পাদক অ্যালান রাসব্রিজার, যিনি উইকিলিকসের সঙ্গে ফাঁস হওয়া নথির কিছু বিষয়বস্তু প্রকাশ করে বৈশ্বিক শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তিনি বলেছেন, এটি ‘খুবই বিরক্তিকর’ যে, যারা রাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর তথ্য প্রকাশ করেছে তাদের লক্ষ্যবস্তু করতে গুপ্তচরবৃত্তি আইনগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমি দুঃখিত যে, গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে একটি আবেদন করা হয়েছে। কেননা, আমার মনে হয় না, আসলে কেউই মনে করে না সে যা করছিল তা গুপ্তচরবৃত্তি।’ রাসব্রিজার আরও বলেন, ‘তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে জেল কাটছে। আমি আশা করি, তার শাস্তি শেষ হবে।’রাসব্রিজার বলেছিলেন, অ্যাসাঞ্জই প্রথম ‘আধা-অ্যাক্টিভিস্ট, আধা-প্রকাশক, আধা-সাংবাদিকদের এই নতুন ধরণটির পথপ্রদর্শক যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে অসাধারণ প্রভাব ফেলেন’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল তাকে ব্যবহার করে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোতে সংবেদনশীল সংবাদ প্রকাশ করা অন্যান্যের বিরত রাখতে নজির স্থাপন করা। তিনি বলেছিলেন, ‘জাতীয়-নিরাপত্তা বিষয়ক রিপোর্টিংকে স্থিমিত রাখা যদি এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে আমি আশঙ্কা করছি, এটি সম্ভবত কাজে দিয়েছে।’ অ্যাসাঞ্জের সমর্থকরা বলছেন, তাদের কাছে তিনি একজন নায়ক যার বিরুদ্ধে অবিচার করা হয়েছে। কেননা, তিনি আফগানিস্তান ও ইরাকের সংঘাতসহ মার্কিন অন্যায় এবং কথিত যুদ্ধাপরাধের কথা প্রকাশ করেছেন। ওয়াশিংটন বলেছে, নথি ফাঁস করার মাধ্যমে অ্যাসাঞ্জ আইন লঙ্ঘন করেছেন যার ফলে মার্কিন নাগরিকদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন নাইট ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক জামিল জাফর বলেছেন, এই চুক্তির অর্থ হলো ‘সাংবাদিকরা প্রতিদিন যে ধরনের কাজ করেন সে একই কাজ করার জন্য অ্যাসাঞ্জকে পাঁচ বছর জেল কাটতে হলো।’ একটি ইমেইল বিবৃতিতে জাফর বলেছেন, ‘এটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, সারাবিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরণের সাংবাদিকতার ওপর একটি ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।’ কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট বলেছে, এমন বিচার বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। সিপিজে সিইও জোডি গিন্সবার্গ বলেছেন, ‘যদিও আমরা তার কারাবাসের সমাপ্তিকে স্বাগত জানাই, তবে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসাঞ্জের পিছু নেওয়াটা একটি ক্ষতিকারক আইনি নজির স্থাপন করেছে। সাংবাদিকরা তথ্য ফাঁসকারীদের কাছ থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহ করলে গুপ্তচরবৃত্তি আইনের অধীনে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পথ খুলে দিয়েছে এটি।’
https://www.kaabait.com