ধর্মপাতা: পৃথিবীর জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। পরকালের জীবনের কাছে দুনিয়ার জীবনের উদাহরণ হলো বিশাল সাগরের পানি সম্ভারের তুলনায় এক ফোটা পানির মত। মূলত: আমরা সবাই রূহের জগতে ছিলাম সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে এই ধরায় আমাদের পাঠানো হচ্ছে। আবার হায়াত বা জীবনের নির্দিষ্ট সময় শেষ হলেই চলে যেতে হচ্ছে। এই যে, আসা এবং যাওয়া এর মধ্যে আমাদের রব আল্লাহ তায়ালার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিহিত। তিনি মানুষের মৃত্যু দিয়ে তাদের পৃথিবীর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান। কিন্তু কিছু কিছু মানুষকে দিয়ে দুনিয়ায় এমন সব কাজ করিয়ে নেন যার মাধ্যমে তিনি মারা গেলেও কাল থেকে কালান্তরের মানুষের কাছে বেঁচে থাকেন। যুগ যুগ ধরে মানুষেরা তার জীবন কর্ম থেকে অনুপ্রাণিত হয় এবং তাদের আলোকিত জীবন থেকে দ্যুতি নিয়ে প্রদীপ্ত হয়। কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “কুল্লু নাফসিন যায়িকাতুল মাউত” অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’ পৃথিবীতে কেউ স্থায়ী নয়। এখানে আমরা প্রতিনিয়ত অবলোকন করছি যে, মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আমরা যদি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখবো, এক সময় এই পৃথিবীতে আমরা কেউ ছিলাম না। পৃথিবীও ছিল না। আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় হলো, তিনি তার প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে মনস্থির করলেন। সৃষ্টিও করলেন প্রতিনিধি। আর আদম (আ.) এর পৃষ্ঠদেশ হতে তার সব সন্তানদের বের করে সেই রূহের জগতে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি কি তোমাদের রব নই?” তখন সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, হ্যাঁ, আপনি আমাদের রব। এরপর আদম ও হাওয়াকে দুনিয়ায় নামিয়ে দিলেন। সাথে সাথে বললেন, তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে অধ্যাদেশাবলী যাবে। সেটা যদি মান্য কর তাহলে তোমাদের জন্য কোন ভয় ও চিন্তা নেই। এরপর দুনিয়ার জীবনের একটা সময়সীমা আল্লাহ নির্ধারণ করলেন। সেই নির্ধারিত সময় শেষ হলেই আল্লাহর কাছে হাজির হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকবে না। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, “আইনামা তাকুনু ইউদরিক কুমূল মাউত অলাও কুনতুম ফি বুরুজিম মুশাইয়্যাদা’ অর্থাৎ মৃত্যু হতে বাঁচার জন্য যদি কেউ সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যেও আশ্রয় নেয় তবুও মৃত্যু তাকে সেখানে পাকড়াও করবে” সুতরাং কেউ যদি মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে পৃথিবীকে অনন্ত নিবাস ভাবে তাহলে সেটা হবে একান্তই বোকামী। রসূল (স.) এক সমাবেশে তাঁর সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, “কে সবচেয়ে বুদ্ধিমান? সাহাবীরা স্বভাবসুলভভাবে বলেছিলেন, আল্লাহ এবং তার রসূলই ভাল জানেন”। তখন রসূল (স.) বললেন, সেই ব্যক্তি প্রকৃত বুদ্ধিমান যিনি মৃত্যুর জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকে। সাহাবীরা বললেন, হে রসূল (স.)! আমরা মৃত্যুর জন্য কিভাবে প্রস্তুত থাকবো? রসূল (স.) বললেন, মৃত্যু যে খুব নিকটে সে মোতাবেক প্রস্তুত থাকবে। সাহাবীরা আবার বললেন, ‘হে রসূল (স.)! আপনি মৃত্যুকে কেমন নিকটবর্তী মনে করেন? রসূল (স.) বললেন, আমি যখন নামাজে ডানে ছালাম ফিরায় তখন মনে হয় বামে ছালাম ফিরাতে পারবো না এর মধ্যে মৃত্যু এসে যেতে পারে।” একদিন জিব্রাইল (আ.)
মহানবী (স.) এর কাছে একটি আয়াত নিয়ে এলেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘দুনিয়ার জীবন খেলাধুলা করার মত মুহূর্ত ছাড়া আর কিছু নয়, প্রকৃত জীবন হলো পরকালের জীবন।” সে কারণে রসূল (স.) বলেছিলেন, আখেরাতের চিন্তা ছাড়া দুনিয়ার জীবন কখনো পরিচ্ছন্ন হতে পারে না। যেমন একদিন রসূল (স.) বাড়িতে এসে দেখলেন তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা (রা.) কাঁদছেন। রসূল (স.) তাঁর কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে আয়শা (রা.) বললেন, “পরকালের চিন্তাই আমাকে কাঁদাচ্ছে”। তাছাড়া দুনিয়ার সংকীর্ণ জীবন শেষ করে সবারইতো পরকালের যাত্রী হতে হবে। তাহলে আল্লাহ আমাদের কেন এই পৃথিবীতে পাঠালেন? এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “জীবন ও মৃত্যু এই জন্য সৃষ্টি করেছি যে, আমি দেখতে চাই তোমাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে”। কবি শেখ সাদী (রহ.) বলেছেন, ‘ইয়া হামছবে মুসাফির হ্যায় ওহি আখের ঠিকানা কুয়ি আগে রওয়ানা হ্যায় কুয়ি পিছে রওনা’, অর্থাৎ পৃথিবীতে আমরা সবাই মুসাফির বা ভ্রমণকারীর মত। পার্থক্য হলো এই যে, কেউ আগে আসে আগে যায়, আর কেউ পরে আসে পরে যায়। আল্লাহর নবী হযরত মুসা (আ.)-এর যখন মৃত্যুর সময় হলো তখন আজরাইল (আ.) চলে এলেন। মুসা (আ.) মৃত্যুর ফেরেশতাকে বললেন, ‘আমার এখনো মুত্যুর সময় হয়নি; তুমি আমার রবকে যেয়ে একথা বলো। মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইল (আ.) আল্লাহ তায়ালাকে এ বিষয়টি অবহিত করলে আল্লাহ বললেন, হে আজরাইল! আমার নবী মুসাকে যেয়ে বলো তিনি যদি বনি ইসরাইলের কোন একটি পশুর পিঠে হাত রাখেন, তাহলে তাঁর হাতের নিচে যত পশম পড়বে তত বছর তার হায়াত বাড়িয়ে দেয়া হবে। আজরাইল (আ.) এই কথা মুসা (আ.) কে জানালে, মুসা (আ.) বললেন, “আমি বনি ইসরাইলের কোন একটি পশুর পিঠে হাত রাখলাম। আমার হাতের নিচে যত হাজার পশম পড়লো, ততোবছর আমার হায়াত বাড়িয়ে দেয়া হলো। তার পর কি হবে? মৃত্যুর ফেরেশতা বললেন, তার পর আপনার মৃত্যু হবে। মুসা (আ.) বললেন, ‘সেই যখন আমাকে মরতেই হবে তাহলে দেরি করে কি লাভ? বরং তুমি এখনই আমার প্রাণটা নাও”। একটি দৃষ্টান্ত হাদীসে এভাবে এসেছে রসূল (স.)
একদিন তার কিছু সাহাবী নিয়ে বসে ছিলেন, হঠাৎ করে সামনে দিয়ে একটি মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাওয়া হলো। সাহাবীরা বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রসূল (স.) ঐ লোকটি ভাল ছিল। এই কথা বলার কিছুক্ষণ পর রসূল (স.) বললেন, হে সাহাবীরা, তোমরা লোকটিকে ভাল বলেছো বিধায় আল্লাহর দরবারেও সে ভাল হিসেবে গৃহিত হয়েছে। এই ঘটনার কিছু দিন পর এরকম আর একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সাহাবীরা তখন বললেন, হে নবী (স.) ঐ লোকটি দুষ্ট প্রকৃতীর ও মন্দ ছিল। রসূল (স.) বললেন, তোমরা লোকটিকে মন্দ বলছো, বিধায় সে আল্লাহর দরবারেও মন্দ হিসেবে গৃহিত হয়েছে। সুতরাং একজন ভাল লোক মারা গেলে সকলেই স্বত:স্ফূর্তভাবে তাকে ভাল বলেই সাক্ষ্য দেয়। আর কোন মন্দ লোক মারা গেলে মানুষেরা তাকে মন্দ
বলেই সাক্ষ্য দেয়। আর ঈমানদারদের এই সাক্ষ্যের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে অত্যাধিক। আমরা যেমন
আমাদের পূর্ববর্তীদের মৃত্যুবরণ করতে দেখেছি। তেমনি আমাদের সকলকেই মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করতে হবে। পৃথিবী হতে চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় যাব? সেটা আরেকটি মঞ্জিল। আরেকটি জগৎ। যাকে হাদীসে আলমে বরজাখ বা প্রতিবন্ধনের জগৎ বলা হয়েছে। মৃত্যু পরবর্তী সময়ে যেখানে আমাদের থাকতে হবে। খুব ছোট-খাট সে ঘর। কিন্তু ঈমানের বলে এই ঘর কারো দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। ঘরটি হবে আলোকিত। থাকবে সাজানো-গোছানো সজ্জা। ফল-ফুল খাদ্য সামগ্রী সেখানে ভরপুর থাকবে। জান্নাতের দিকে ঘরের একটি দরজা খোলা হবে। সর্বদা তিনি জান্নাতের আলো, বাতাস ও সুঘ্রাণে রোমাঞ্চকর থাকবেন। মূলত: সেটি হবে বেহেশতের একটি টুকরা বা অংশ। পক্ষান্তরে ঈমানের ঘাটতির কারণে ছোট ঘরটি কারও জন্য ক্ষুদ্রতর হয়ে যাবে। নড়া চড়া করার কোন উপায় থাকবে না। বরং তার ঘর বা কবরের দু’পাশের মাটি পৃথিবীর দুই প্রান্তে চলে যাবে। দুই দিক হতে এমন জোরে ধাক্কা দিবে যে, তার একটি পাঁজর অন্যটির সাথে মিশে যাবে। জাহান্নামের আজাবের প্রাণী সাপ বিচ্ছু অনবরত তাকে দংশন করতে থাকবে। ঘরটি হবে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জাহান্নামের দিকে তার কবরের একটি দরজা খুলে দেয়া হবে। যার কারণে জাহান্নামের আগুনের হলকা সব সময় তার কবরে প্রবেশ করতে থাকবে। মূলত: তার কবরটি হবে জাহান্নামের একটি টুকরা বা অংশ। কেয়ামত পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে। তাছাড়া যারা দুনিয়ায় কিছু ভাল কাজ করে গেছেন তাদের জন্য কবরের আজাব কিছুটা হালকা করা হবে। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, মানুষ যখন মারা যায় তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায় ৩টি ছাড়া ১. সাদকায়ে জারিয়াহ বা সমাজে এমন ভাল কাজ চালু করে যাওয়া যার সুফল মানুষেরা ভোগ করে। ২. উপকারী জ্ঞান: তার রেখে যাওয়া যে জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের হৃত সাধন হয়। ৩. সৎ সন্তান: যে তার পিতা মাতার জন্য দোয়া করে। যদি কোন ব্যক্তি উপরোক্ত এই তিনটি কাজ করে কবরের বাসিন্দা হয়ে যান তাহলে তার কবরের আজাব কিছুটা কমানো হবে। কবরের জীবনের পরিসমাপ্তিও এক সময় ঘটবে। যখন আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইস্রাফিল (আ.) সিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন। তখন কেয়ামত সংঘটিত হবে। সকল মানুষ আল্লাহর দরবারে সেদিন হাজির হবে। তখন আল্লাহ কাহ্হার রূপ ধারণ করে বিচারকের সিংহাসনে বসবেন। সেদিন কারো প্রতি অবিচার করা হবে না। সকলের প্রতি তিনি সুবিচার করবেন। তাই বুঝতে হবে দুনিয়ার জীবন খেলাধুলা করার মুহূর্ত ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃত জীবন হলো আখেরাতের জীবন। যে জীবনের কোন সীমা নেই। শেষ নেই। সংকীর্ণতা নেই। মৃত্যু নেই। যেখানে মৃত্যুহীন অসীম জীবন নিয়ে অবিনশ্বর জগতে অনন্তকাল যাতনাময় অথবা শান্তিময় জীবন যাপনের চিরন্তন যাত্রী হতে হবে সকলকে। সুতরাং এই নশ্বর জগতে সকলকে কণ্টকাকীর্ণ দুর্গম অন্ধকারাচ্ছন্ন বাঁকাপথ পরিহার করে সহজ সরল সিরাতুল মুস্তাকিমের আবহে আলোকিত পথের পথিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। (সংকলিত)
https://www.kaabait.com